জোয়ারে নদীর পানি বেড়ে খুলনার দাকোপ উপজেলায় পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) বাঁধ ভেঙে পানিবন্দি হয়ে পড়েছে হাজারো পরিবার, প্রায় দুই হাজার ২৩১ বিঘা জমির আমন ধান তলিয়ে গেছে। পাউবোর ১৫০ ফুট বেড়িবাঁধ ভেঙে নদীগর্ভে চলে গেছে। কয়েকটি এলাকা প্লাবিত হয়েছে। ভেসে গেছে ঘের ও পুকুরের মাছ। পাউবো ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের উদ্যোগে ভাঙনকবলিত স্থানে পুনরায় বাঁধ নির্মাণের চেষ্টা চলছে।
মঙ্গলবার রাতে উপজেলার তিলডাঙ্গা ইউনিয়নের বটবুনিয়া হরিসভা মন্দিরসংলগ্ন ঢাকী নদীর বাঁধ ভেঙে বটবুনিয়া গ্রাম ও নিশানখালী বিলে পানি ঢুকে পড়ে। বুধবার সকালে স্থানীয় লোকজন স্বেচ্ছাশ্রমে বাঁধটি মেরামতের চেষ্টা চালান। তবে বিকাল পর্যন্ত বাঁধ আটকানো সম্ভব হয়নি।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, তিনটি বিচ্ছিন্ন দ্বীপ নিয়ে দাকোপ উপজেলা। উপজেলার নয়টি ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভার মধ্যে ৩১ নম্বর পোল্ডারের আওতায় পড়েছে পানখালী ও তিলডাঙ্গা ইউনিয়ন এবং চালনা পৌরসভা। বটবুনিয়া গ্রামে গত বছরও দুই জায়গায় বাঁধ ভেঙে প্লাবিত হয়েছিল। এ বছরের সেপ্টেম্বর মাসের শেষ দিকে গত রাতের ভেঙে যাওয়া জায়গা ব্যাপক ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছিল। পাউবোর সহায়তায় স্থানীয় লোকজন মাটি ও জিও বস্তা দিয়ে সেটা কোনোমতে টিকিয়ে রেখেছিলেন। মঙ্গলবার রাতে ভরা জোয়ারে মুহূর্তের মধ্যে মূল বাঁধের প্রায় ৫০ মিটার ঢাকী নদীতে চলে যায়। এরপর জোয়ারের পানি হু হু করে লোকালয়ে ঢুকে পড়ে। সকালের জোয়ারের আরেক দফা প্লাবিত হয়েছে এলাকা। বিকাল পর্যন্ত পাউবোর বেড়িবাঁধের ১৫০ মিটার নদীতে সম্পূর্ণভাবে বিলীন হয়ে যায়। বাঁধ ভেঙে ঘরবাড়িতে পানি ঢুকেছে। তবে সকালে নদীর পানি নেমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ওই এলাকার বাসিন্দা প্রকাশ বালা, সঞ্জিত বালা, তারাপদ বালা, শ্রীকান্ত বালা, সুরঞ্জন বালা ও সঞ্জয় সরদারসহ অনেকে বসতঘর ও জিনিসপত্র অন্যত্র সরিয়ে নেন।
স্থানীয় বাসিন্দারা জানায়, ‘গভীর রাতে চোখের সামনেই আমার বসতঘর নদীতে চলে যায়। পরে অন্যের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছি। কিন্তু এখন কোথায় থাকবো, তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছি।’
স্থানীয় বাসিন্দারা বলেন ‘ভেঙে যাওয়া বাঁধের ওপর বাঁধ নির্মাণ আমরা আর দেখতে চাই না। সরকারের কাছে খাদ্য, বস্ত্র ও বাসস্থানের সহায়তা চাই না। এখানে টেকসই বাঁধ নির্মাণ দেখতে চাই আমরা।’
তিলডাঙ্গা ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান মো. জালাল উদ্দিন গাজী সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, ‘নদীর জোয়ারে অতিরিক্ত পানির চাপে মঙ্গলবার রাত ১২টার দিকে ইউনিয়নের বটবুনিয়া হরিসভা এলাকায় পাউবোর বেড়িবাঁধ ভেঙে নদীতে বিলীন হয়ে যায়। এতে ওসব এলাকার ঘরবাড়ি ও আমন ক্ষেত ডুবে যায়। বুধবার সকালে জিওব্যাগ ফেলে বাঁধ আটকানোর চেষ্টা করা হয়। কিন্তু ব্যর্থ হওয়ায় দুপুরের জোয়ারে আবার এলাকায় পানি ঢুকেছে। বর্তমানে এলাকার অনেক লোকজন পরিশ্রম করে পুনরায় বাঁধ নির্মাণের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। বাঁধ দিতে না পারলে আমন ফসলসহ মানুষের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হবে।’
ওই ইউপির ৭ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য সঞ্জয় সদরদার জানিয়েছেন, স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে চেষ্টা চালিয়েও বাঁধটি মেরামত করে পানি আটকানো সম্ভব হয়নি। এরই মধ্যে এলাকার দুই হাজার বিঘা আমন পানির নিচে তলিয়ে গেছে। পানি এখন পাশের পানখালী ইউনিয়নেও চলে যাবে। বাঁধ দিতে না পারলে বড় ক্ষতি হবে।’
দাকোপ উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. শফিকুল ইসলাম জানান, বাঁধ ভেঙে ৩০০ হেক্টর (প্রায় দুই হাজার ২৩১ বিঘা) আমন প্লাবিত হয়েছে। তবে ভাটার সময় পানিটা সরে যাচ্ছে। বাঁধ এখনই মেরামত করতে পারলে ক্ষতি কমবে। তারপরও ভেঙে যাওয়া জায়গার মুখের কাছের কিছু জমির ফসল বালুতে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর খুলনার উপপরিচালক মো. নজরুল ইসলাম বলেন, ‘বুধবার সন্ধ্যা সাড়ে ৬টা পর্যন্ত পানি আটকানো সম্ভব না হওয়ায় ৩০০ হেক্টর জমির আমন ধান ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। জোয়ারের চাপ আসলে প্লাবিত এলাকার সংখ্যা বাড়ছে। দুই দিনের মধ্যে বাঁধ দেওয়া সম্ভব না হলে এসব আমন ধান রক্ষা করা কঠিন হবে। ভাটিতে পানি নামার পর বাঁধ আটকানো সম্ভব হলে ধান রক্ষা হতে পারে।’
স্থানীয় সূত্র জানায়, গত এক বছরে ৩১ নম্বর পোল্ডারের কাজীবাছা, শিবসা, ঢাকী নদীর বিভিন্ন জায়গার বাঁধ ভেঙে লোকালয়ে পানি ঢুকেছে। গত বছরের মে মাসে বটবুনিয়া বাজারসংলগ্ন ঢাকী নদীর বাঁধ ভেঙে এলাকা প্লাবিত হয়। গত বছরের সেপ্টেম্বরে ঢাকী নদীর বাঁধ ভেঙে পানখালী ইউনিয়নের খোনা গ্রামে পানি ঢুকেছিল।
পাউবো ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধি সূত্রে জানা যায়, ষাটের দশকে নির্মিত ৩১ নম্বর পোল্ডারের বেড়িবাঁধের বিভিন্ন পয়েন্ট ভীষণ ঝুঁকিপূর্ণ। সারা বছরই জোড়াতালি দিয়ে কাজ চলে। মাঝেমধ্যে সেগুলো ভেঙে যায়। স্থানীয় লোকজন স্বেচ্ছাশ্রমে সেগুলো মেরামত করেন। তবে ৩১ নম্বর পোল্ডারে জাইকার অর্থায়নে একটি প্রকল্পের আওতায় ৩ হাজার ৭৫০ মিটার স্থায়ী নদীশাসনের কাজ চলমান। এই পোল্ডারের টেকসই বাঁধ নির্মাণে মন্ত্রণালয়ে উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব (ডিপিপি) পাঠানো আছে। সেটা এখনও পাস হয়নি।
খুলনা পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আশরাফুল আলম বলেন, ‘৩১ নম্বর পোল্ডারের বিভিন্ন স্থানে ঝুঁকিপূর্ণ বাঁধ সংস্কারের কাজ চলছে। পানি নেমে যাওয়ার পর ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান প্রয়োজনীয় জনবল ও সারঞ্জমাদি নিয়ে বটবুনিয়া বাজার এলাকায় ভেঙে যাওয়া বাঁধের কাজ শুরু করবে। ইতিমধ্যে সেখানে ডাম্পিং ও বালু ভর্তি টিউব ব্যাগ ফেলা হয়েছে। বাঁধ নির্মাণে স্থানীয় কৃষকদের জমি থেকে মাটি কাটতে গেলে ঠিকাদারের লোকজন দুই-একজন কৃষকের বাধার মুখে পড়েন। জমিতে আমন থাকায় মাটি কাটতে দিচ্ছেন না তারা। এজন্য বাঁধের ওপর মাটি ফেলা যাচ্ছে না। আমরা বাঁধটি সংস্কারের চেষ্টা করছি।’