“বোবায় ধরা ভূতে ধরা নয়, ঘুমের ছন্দের সমস্যা।”
‘বোবায় ধরা’ কী?
‘বোবায় ধরা’ রোগটি চিকিৎসা বিজ্ঞানে Sleep Paralysis বা ঘুমজড়তা বলে পরিচিত। ফলে, বোবায় ধরা বিষয়ে জানতে হলে আমাদের ঘুমের স্তর সম্পর্কে জানতে হবে।
মোটাদাগে ঘুমের ২ টি স্তর-
১. ধীরে চোখ নড়াচড়া স্তর (Non-REM- Non-Rapid Eye Movement) বা হালকা-ঘুম স্তর এবং
২. দ্রুত চোখ নড়াচড়া স্তর (REM- Rapid Eye Movement) বা গভীর-ঘুম স্তর।
প্রথম স্তর, Non-REM-এর আবার ৩টি স্তর-
১. Stage N1 (হালকা ঘুম): সহজে ভাঙা যায়, মাথা নোয়ানো, চমকে ওঠা।
২. Stage N2 (মাঝারি গভীর ঘুম): শরীরের টেম্পারেচার ও হার্ট রেট কমে যায়।
৩. Stage N3 (গভীর ঘুম): শরীর মেরামত হয়, গ্রোথ হরমোন নিঃসৃত হয়।
দ্বিতীয় স্তর, REM Sleep-এর কোনো স্তর নেই তবে মস্তিষ্কের তরঙ্গ বা ওয়েভ বা ফ্রিকোয়েন্সির সাথে এর সম্পর্ক আছে। যেমন- বিটা তরঙ্গ, আলফা তরঙ্গ, থেটা তরঙ্গ ও ডেল্টা তরঙ্গ। ঘুমের প্রথম স্তরের সাথেও এই ওয়েব বা তরঙ্গ বা ফ্রিকোয়েন্সির সম্পর্ক আছে।
REM Sleep বা গভীর ঘুমের সময় কী ঘটনা ঘটে?
😔 চোখ দ্রুত নড়াচড়া করে।
😔 স্বপ্ন দেখে।
😔 মস্তিষ্ক সক্রিয় থাকে কিন্তু মাংসপেশী ঢিলা হয়ে যায়।
😔 মাংসপেশী ঢিলা হয়ে যাবার কারণে শরীর অচল অবস্থায় থাকে। এ অবস্থাকে বলে Muscle Atonia।
😔 মস্তিষ্ক শরীর নাড়াতে চায় কিন্তু পেশী অচল অবস্থায় থাকার কারণে শরীর নড়ে না।
😔 এই সময়ে ‘বোবায় ধরা’ বেশি হয়।
বোবায় ধরলে কেমন অনুভূতি হয়?
🤔 স্বপ্ন ও বাস্তবের মাঝামাঝি অবস্থায় থেকে একধরনের হ্যালুসিনেশন হয়।
🤔 হঠাৎ ঘুমের মধ্যে বা ঘুম থেকে জাগার পরপরই শরীর নড়াচড়া করতে পারে না।
🤔 বুকের ওপর ভারি চাপ অনুভব হয়।
🤔 শ্বাস নিতে কষ্ট হবার মতো অনুভূতি হয়।
🤔 অনেক সময় কানে অদ্ভুত শব্দ শোনা, চোখে অদ্ভুত কিছু দেখার মতো অনুভূতি হয়।
🤔 খুবই সাময়িকভাবে মুখ দিয়ে অনিচ্ছুক শব্দ, গোঙানি বের হতে পারে।
🤔 ভয় পেয়ে হাত-পা কাঁপতে পারে।
🧠 বোবায় ধরার বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা:
আগেই বলেছি, ঘুমের গভীর স্তর বা REM Sleep স্তরে মস্তিষ্ক সক্রিয় থাকে কিন্তু মাংসপেশী ঢিলা হয়ে যাবার কারণে শরীর অচল অবস্থায় থাকে। এই স্তরে সক্রিয় মস্তিষ্ক স্বপ্ন দেখে।
🧠 সক্রিয় মস্তিষ্ক স্বপ্ন দেখার পর অনেকসময় কিছুটা স্বাভাবিকের মতো জেগে ওঠে।
🧠 মস্তিষ্ক জেগে উঠলেও তখন পর্যন্ত শরীর জেগে ওঠে না, অর্থাৎ মাংসপেশী তখনো প্যারালাইজড থাকে।
🧠 এই অবস্থায় মস্তিষ্ক শরীর নাড়ানোর জন্য সিগনাল পাঠায় কিন্তু প্যারালাইজড থাকায় মাংসপেশী রেসপন্স করতে পারে না, ফলে শরীর নড়ে না।
🧠 মস্তিষ্ক সজাগ থাকায় মানুষ বুঝতে পারে, সে হাত-পা নাড়াতে পারছে না।
🧠 স্বপ্নঘোর ও বাস্তবের মাঝামাঝি এই সময়ে একধরনের হ্যালুসিনেশন হয়। এই হ্যালুসিনেশনকেই মানুষ ভূতেধরা, অশরীরী আছর বা বোবায় ধরা বলে।
✅ বোবায় ধরলে রোগীর করণীয়:
✔ আতঙ্কিত হওয়া যাবে না।
✔ আস্থা আনতে হবে- এটা রোগ, ভূত নয়, শরীরের একটা সাময়িক অবস্থামাত্র।
✔ সবার আগে চোখ নাড়ানোর চেষ্টা করতে হবে, কারণ, প্রথমে এই অনুভূতিটাই সক্রিয় হয়।
✔ গভীরভাবে শ্বাস নেওয়ার চেষ্টা করতে হবে।
✔ হাত-পায়ের আঙুল নাড়ানোর চেষ্টা করতে হবে।
✔ ধীরে-ধীরে শরীর স্বাভাবিক নড়াচড়ায় ফিরে আসবে।
👨❤️👨 পাশে থাকা মানুষের করণীয়:
✔ রোগীর নাম ধরে বা সম্বোধন কোরে ডাকতে হবে এবং শরীরে হালকা ঝাঁকুনি দিতে হবে।
✔ আতঙ্ক বা কুসংস্কারমূলক কিছু বলা যাবে না।
✔ শান্তভাবে বোঝাতে হবে- এটা কিছুই না, অস্থায়ী, কিছুক্ষণের মধ্যেই ঠিক হয়ে যাবে।
✔ বারবার আক্রান্ত হলে ডাক্তার দেখাবার জন্য উৎসাহিত করতে হবে।
⁉️কেন ‘বোবায় ধরা’ অনুভূত হয়:
– অনিয়মিত ঘুম
– অতিরিক্ত দুশ্চিন্তা
– রাত জাগা
– অতিরিক্ত ক্লান্তি
– নারকোলেপসি
🩺 চিকিৎসা ও প্রতিরোধ:
✔ নিয়মিত ও পরিমিত ঘুমানো
✔ স্ট্রেস ম্যানেজমেন্ট বা দুশ্চিন্তামুক্ত থাকা
✔ ব্যায়াম ও স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন করা
✔ নেশাজাতীয় দ্রব্য সেবন না করা
✔ ঘন-ঘন আক্রান্ত হলে ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া
📚 রেফারেন্স
1. American Academy of Sleep Medicine (ICSD-3), 2014
2. Sharpless BA, Barber JP. Sleep paralysis prevalence. Sleep Med Rev. 2011;15(5):311–315
3. Cheyne JA. Hallucinations in sleep paralysis. J Sleep Res. 2002;11(2):179–188
4. Jalal B, Hinton DE. Sleep paralysis and cultural beliefs. J Nerv Ment Dis. 2015;203(11):871–875
🩺
অধ্যাপক ডা. শেখ মো. নাজমুল হাসান,
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও ডায়াবেটোলজিস্ট। চর্ম ও যৌনরোগ এবং মেডিসিনে উচ্চতর প্রশিক্ষণ।
৩০ বছরের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন। ২৬টি বইয়ের লেখক এবং গবেষক। PubMed, ResearchGate-এর মতো বিখ্যাত রিসার্চ ওয়েবসাইটে অনেক গবেষণাকর্ম প্রকাশিত।