গবেষণা অনুযায়ী, পৃথিবীর নিরাপদ কার্বন সঞ্চয় ক্ষমতা আগের অনুমানের চেয়ে অনেক কম এবং ২২০০ সালের মধ্যেই শেষ হয়ে যেতে পারে। এটি বৈশ্বিক উষ্ণায়ন নিয়ন্ত্রণে বড় বাধা তৈরি করবে। ধনী দেশের উৎপন্ন কার্বন সংরক্ষণের বোঝা হয়তো দরিদ্র ও কম নিঃসরণকারী দেশগুলোর ওপর চাপবে। যদিও প্রযুক্তিগত উন্নতি ও সতর্ক ব্যবস্থাপনায় কিছু ঝুঁকি এড়ানো সম্ভব।
পৃথিবীর শিলাস্তরে কার্বন-ডাই অক্সাইড জমা রাখার ক্ষমতা আগের ধারণার তুলনায় অনেক কম, আর এই ক্ষমতা ২২০০ সালের মধ্যেই শেষ হয়ে যেতে পারে বলে সম্প্রতি Nature জার্নালে প্রকাশিত এক গবেষণায় জানানো হয়েছে।
২০১৫ সালের প্যারিস চুক্তির লক্ষ্য হচ্ছে শিল্প বিপ্লব-পূর্ব সময়ের তুলনায় বৈশ্বিক উষ্ণায়নকে ১.৫–২0 সেলসিয়াসের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা। এর জন্য বিপুল পরিমাণ কার্বন-ডাই অক্সাইডকে (CO₂) বায়ুমণ্ডল থেকে অপসারণ করতে হবে। এর একটি উপায় হলো শিল্প কারখানায় উৎপন্ন CO₂ সংগ্রহ করে গভীর ভূগর্ভে সংরক্ষণ করা।
গবেষকরা জানিয়েছেন, পৃথিবী নিরাপদভাবে প্রায় ১,৪৬০ গিগাটন CO₂ জমা রাখতে সক্ষম। এটি আগের গবেষণায় উল্লেখিত ১০,০০০–৪০,০০০ গিগাটন CO₂ অনুমানের তুলনায় অনেক কম। বর্তমানে কার্বন সংগ্রহ ও সঞ্চয় প্রযুক্তি প্রতি বছর মাত্র ৪৯ মিলিয়ন টন CO₂ অপসারণ করে, আর পরিকল্পিত নতুন প্রকল্প মিলিয়ে এ ক্ষমতা বছরে ৪১৬ মিলিয়ন টন পর্যন্ত পৌঁছাবে। অথচ প্যারিস চুক্তির লক্ষ্যে পৌঁছাতে হলে ২০৫০ সালের মধ্যে বছরে ৮.৭ গিগাটন CO₂ জমা রাখতে হবে যা আগামী তিন দশকে বর্তমান সক্ষমতার চেয়ে ১৭৫ গুণ বেশি।
পৃথিবীর মোট ভৌত সঞ্চয় ক্ষমতা আনুমানিক ১১,৮০০ গিগাটন CO₂। কিন্তু ভূমিকম্পজনিত কার্বন নিঃসরণ ঝুঁকি ও রাজনৈতিক কারণে সব জায়গায় প্রবেশাধিকার না পাওয়ার মতো বাস্তব সমস্যাগুলো হিসাব করলে কার্যকর ক্ষমতা নেমে আসে ১,৪৬০ গিগাটন CO₂-এ। গবেষণাটি মূলত স্থিতিশীল অবক্ষেপনীয় অববাহিকার (sedimentary basins) দিকে নজর দিয়েছে, যেখানে অধিকাংশ সম্ভাব্য সঞ্চয় ক্ষেত্র চিহ্নিত হয়েছে।
এই ১,৪৬০ গিগাটন CO₂ যদি পুরোপুরি বায়ুমণ্ডল থেকে কার্বন অপসারণে ব্যবহার করা হয়, তবে তা বৈশ্বিক উষ্ণায়ন সর্বোচ্চ ০.৭0 সেলসিয়াস পর্যন্ত কমাতে পারবে। কিন্তু বর্তমান প্রবণতা অনুসারে এই শতকে বৈশ্বিক উষ্ণায়ন ৩0 সেলসিয়াস পর্যন্ত বাড়তে পারে। অর্থাৎ সব চিহ্নিত ভূতাত্ত্বিক সঞ্চয় ব্যবহার করলেও উষ্ণায়নকে ২0 সেলসিয়াস-এ নামানো সম্ভব হবে না বলে জানান গবেষণার সহ-লেখক ও ইম্পেরিয়াল কলেজ লন্ডনের জলবায়ু বিজ্ঞানী জয়েরি রোজেলজ।
তাছাড়া, সঞ্চিত CO₂ যদি ভূ-পৃষ্ঠে বেরিয়ে আসে, তবে তা ভূগর্ভস্থ পানিতে কার্বনিক অ্যাসিড তৈরি করতে পারে। ফলে অ্যাসিডিক পরিবেশে ধাতু-সমৃদ্ধ খনিজ গলে গিয়ে বিষাক্ত ধাতু ছড়িয়ে পড়তে পারে, যা মানুষ ও পরিবেশ উভয়ের জন্য ক্ষতিকর।
ইন্দোনেশিয়া, ব্রাজিল ও আফ্রিকার কিছু অঞ্চলে তুলনামূলকভাবে বেশি এবং নিরাপদ সঞ্চয় ক্ষমতা রয়েছে। অথচ এ দেশগুলো ঐতিহাসিকভাবে বৈশ্বিক নিঃসরণে কম অবদান রেখেছে। কিন্তু ধনী দেশগুলোর উৎপন্ন কার্বন সংরক্ষণের বোঝা হয়তো এদেরকেই বহন করতে হতে পারে। গবেষণার সহ-লেখক এবং জলবায়ু মডেলিং বিশেষজ্ঞ ম্যাথিউ গিডেন বলেন, “জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য দায়ী কারা আর কারা শেষ পর্যন্ত কার্বন পরিষ্কার করবে—এখানে জিত-হার দুটো দিকই আছে।”
যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাস বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ববিদ সুসান হোভোরকা গবেষণার সঙ্গে একমত যে কার্বন সঞ্চয়ের মজুদ অনেক বড় হলেও তা সীমাহীন নয়। তবে তিনি মনে করেন ভূমিকম্পজনিত লিকেজের ঝুঁকিকে গবেষণাটি কিছুটা বেশি করে দেখিয়েছে। তাঁর মতে, প্রকৌশলীরা ভূগর্ভস্থ শিলায় CO₂ প্রবেশ করানোর সময় শিলার মেকানিক্যাল বৈশিষ্ট্য বিবেচনায় নেন। “অর্থাৎ ভূমিকম্প ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা হলেও বর্তমান সর্বোত্তম পদ্ধতি ব্যবহার করে সেখানে CO₂ জমা রাখা সম্ভব,” তিনি বলেন।
অস্ট্রেলিয়ার মোনাশ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূ-যান্ত্রিক প্রকৌশলী রঞ্জিত পাতেগামা গামাগে বলেন, গবেষণায় প্রদত্ত সংখ্যা বেশ রক্ষণশীল। তাই ১,৪৬০ গিগাটন CO₂ হিসেবে উল্লেখিত নিরাপদ সঞ্চয় ক্ষমতা বাস্তবে ভিন্ন হতে পারে।
এই নিবন্ধটি Creative Commons লাইসেন্সের অধীনে বিজ্ঞানবার্তা থেকে পুনঃপ্রকাশিত হয়েছে। নিবন্ধটি লিখেছে সাফিয়া তাবাসসুম রুমু।
