অন্যান্য

আজ বিশ্ব হাতি দিবস।

স্থলভাগের বৃহত্তম প্রাণী হাতি রক্ষায় সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে ২০১২ সাল থেকে প্রতি বছর ১২ই আগস্ট বিশ্ব হাতি দিবস পালন করা হয়ে থাকে। হাতির নিরাপদ করিডোর, আবাস ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে রাষ্ট্রের আরো উদ্যেগী হওয়া প্রয়োজন।

হাতি পৃথিবীর বৃহত্তম স্থলচর স্তন্যপায়ী প্রাণী। আমাদের পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় হাতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। প্রতিবছর ১২ আগস্ট পালিত হয় বিশ্ব হাতি দিবস, যা মূলত হাতির সংরক্ষণ ও এর টিকে থাকার পরিবেশ রক্ষার ওপর গুরুত্বারোপ করে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এ দিবসের তাৎপর্য বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। বাংলাদেশের বনাঞ্চল ও হাতির আবাসস্থল দিন দিন সংকুচিত হয়ে আসছে, যার ফলে হাতির সংখ্যা হ্রাস পাচ্ছে এবং হাতি-মানুষ সংঘাত বেড়ে যাচ্ছে।

আইইউসিএনের ২০১৬ সালের হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশে হাতি চলাচলের করিডোরের সংখ্যা ছিল ১২টি। এই করিডোরগুলো প্রধানত চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার এলাকায় অবস্থিত। এই করিডোরগুলো হাতির অভিবাসন ও চলাচলের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এগুলো হাতিদের এক এলাকা থেকে অন্য এলাকায় নিরাপদে চলাচল করতে সহায়তা করে। তবে এসব করিডোর দিন দিন সংকুচিত হয়ে আসছে, যা হাতির চলাচলে বাধা সৃষ্টি করছে এবং হাতি-মানুষ সংঘাত বৃদ্ধির অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব নেচার (আইইউসিএন) হাতিকে বিশ্বজুড়ে বিপন্ন এবং বাংলাদেশে মহাবিপদাপন্ন প্রাণী হিসেবে চিহ্নিত করেছে। বাংলাদেশে বর্তমানে হাতির সংখ্যা খুবই কম, যা উদ্বেগজনক। আইইউসিএনের ২০১৬ সালের তথ্যানুযায়ী, দেশে মোট হাতির সংখ্যা প্রায় ২৬৮টি। ভারত ও মিয়ানমার থেকে আসা পরিব্রাজক হাতির গড় সংখ্যা ৯৩। বন্দী দশায় আছে নিবন্ধিত এমন ৯৬টি হাতি ছিল সে সময়। গত কয়েক দশকে বন্য হাতির সংখ্যা ক্রমাগত হ্রাস পাচ্ছে, যা মূলত বনাঞ্চল ধ্বংস, চোরাশিকার এবং হাতির আবাসস্থলের সংকটের কারণে হচ্ছে। হাতি-মানুষ সংঘাত ক্রমাগত বাড়ছে, ফলে স্থানীয় জনগণ হাতির আক্রমণের শিকার হচ্ছেন এবং হাতি মারা পড়ছে।

হাতি-মানুষ সংঘাতের মূল কারণ হলো বনাঞ্চল ধ্বংস এবং হাতির আবাসস্থল সংকুচিত হয়ে আসা। বনাঞ্চল কেটে কৃষি জমি ও বসতি গড়ে ওঠার ফলে হাতির জন্য খাদ্য সংকট দেখা দেয়, যা তাদের মানুষের গ্রামে প্রবেশ করতে বাধ্য করে। এর ফলে মানুষের সাথে হাতির সংঘাতের সম্ভাবনা বৃদ্ধি পায়।

কক্সবাজার বনবিভাগ থেকে পাওয়া সুত্রমতে, গত ১০ বছরে কক্সবাজারে বন্যহাতির আক্রমণে মারা গেছেন ৬২ জন। বিদ্যুৎস্পৃষ্টসহ নানা কারণে প্রাণ হারিয়েছে ৩৩টি হাতি। 

বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা- করিডোর পুনরুদ্ধার ও নিরাপদ আশ্রয় নিশ্চিত না হলে আগামী ২০ বছরের মধ্যে কক্সবাজার থেকে বন্যহাতি একেবারেই হারিয়ে যেতে পারে। বাংলাদেশ সরকার ও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা হাতি সংরক্ষণের জন্য বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। ‘বাংলাদেশ বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইন, ২০১২’-তে হাতি শিকার ও হাতির আবাসস্থল ধ্বংস করার জন্য কঠোর শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে। এছাড়া, বন অধিদপ্তর বিভিন্ন সংরক্ষণ প্রকল্পের মাধ্যমে হাতির আবাসস্থল উন্নয়নের চেষ্টা করছে। তবে এসব উদ্যোগের বাস্তবায়নে কিছু চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে। যেমন, সংরক্ষণের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থের অভাব, স্থানীয় জনগণের সচেতনতার অভাব ও দুর্বল আইন প্রয়োগ। উপরন্তু, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবেও হাতির আবাসস্থল ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, যা তাদের অস্তিত্বের জন্য হুমকি স্বরূপ।

বিশ্ব হাতি দিবস শুধু হাতির সংরক্ষণ সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি করার একটি উদ্যোগ নয়, বরং এটি আমাদের পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার জন্য একটি প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে হাতি সংরক্ষণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ আমাদের দেশীয় বনাঞ্চল ও জীববৈচিত্র্যের সঙ্গে হাতির নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। তাই, সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় হাতির সংরক্ষণ ও তাদের জন্য নিরাপদ পরিবেশ গড়ে তোলা আমাদের দায়িত্ব। যথাযথ উদ্যোগ গ্রহণের ফলে আমাদের নিকটবর্তী দেশ শ্রীলঙ্কা ও থাইল্যান্ডে সাম্প্রতিক সময়ে হাতির আবাসস্থলের উন্নতি হয়েছে ও হাতির সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। বাংলাদেশেও হাতি সংরক্ষণের জন্য দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করা অত্যন্ত জরুরি। এর মধ্যে রয়েছে: ১. হাতির জন্য নিরাপদ করিডোর তৈরি করা, যাতে তারা স্বাধীনভাবে চলাচল করতে পারে। ২. বনের ওপর নির্ভরশীলতা কমানোর জন্য স্থানীয় জনগণকে বিকল্প জীবিকা প্রদান। ৩. হাতি সংরক্ষণে নতুন প্রযুক্তির ব্যবহার, যেমন জিপিএস ট্র্যাকিং এবং ড্রোন মনিটরিং। ৪. কৃত্রিম বনায়ন সৃষ্টি ও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলা করার জন্য বিশেষ পদক্ষেপ গ্রহণ।

পরিশেষে সকলকে বিশ্ব হাতি দিবসের শুভেচ্ছা। আমরা যদি কিছু করতে না পারি, তবে প্রাণীটির প্রতি ভালোবাসা বাড়াই, যা তার উপর নির্মমতার জবাব দিবে।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।