গত পঁচিশ বছর ধরে বিজ্ঞানীরা মানুষের জিনোম নিয়ে গবেষণা করছেন। জিনোম মানে আমাদের শরীরের প্রতিটি কোষে থাকা ডিএনএর সম্পূর্ণ তথ্য। এককথায় বললে, ডিএনএ নামের নীল নকশায় লেখা সব তথ্য। ডিএনএর এসব তথ্য—যাকে বিজ্ঞানীরা বলেন ‘জিন’—আমাদের চোখের রং, উচ্চতা, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাসহ সবকিছু নির্ধারণ করে। কিন্তু এতদিন এই ডিএনএর রহস্য পুরোপুরি উন্মোচন করতে পারেননি বিজ্ঞানীরা। এর কিছু অংশ, কিছু জিনের কাজ আসবে কী—সেসব ছিল রহস্যে মোড়া। অজানা। তবে এবার একদল আন্তর্জাতিক গবেষক এসব রহস্যের সমাধান খুঁজে পেয়েছেন। তাঁরা মানুষের জিনোমের এমন এক মানচিত্র তৈরি করেছেন, যা আগে কখনো সম্ভব হয়নি। এই কাজের নেতৃত্ব দিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব কানেক্টিকাটের জেনেটিকস অ্যান্ড জিনোম সায়েন্সের সহযোগী অধ্যাপক ক্রিস্টিন বেক।
জিনোম রহস্যের সমাধান কেন গুরুত্বপূর্ণ
ভাবতে পারেন, মানুষের জিনোমের কিছু অংশ রহস্যঘেরা থাকলেই-বা কী? এ রহস্যের সমাধান না হলে কীই-বা আসে যায়? আসলে, এই অংশগুলোতে লুকিয়ে ছিল আমাদের শরীর সম্পর্কিত অনেক জরুরি তথ্য। যেমন হজমশক্তি, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা এবং মাংসপেশি কীভাবে কাজ করে—এসব ব্যাপারে অনেক তথ্য পাওয়া গেছে এ গবেষণা থেকে। এতদিন এই তথ্যগুলো বিজ্ঞানীরা জানতেন না। ফলে অনেক অসুখের আসল কারণ তাঁরা ধরতেও পারছিলেন না। অনেক সময় ডাক্তাররা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখতেন, রোগীর সব জেনেটিক টেস্ট রিপোর্ট ঠিক আছে, কিন্তু তবু সে অসুস্থ। এখন এসব সমস্যার সমাধান হবে। স্পাইনাল মাসকুলার অ্যাট্রফি নামে শিশুদের একটি মারাত্মক রোগের কারণ লুকিয়ে ছিল জিনোমের এই অজানা অংশে।
আবার আমাদের জিনের মধ্যে এমন কিছু জায়গা আছে, যা ১০০টিরও বেশি রোগের সঙ্গে যুক্ত। বিজ্ঞানীরা প্রথমবারের মতো সেই জটিল জায়গাগুলো নিয়ে স্পষ্ট ধারণা পেয়েছেন এই গবেষণার মাধ্যমে।
এতদিন পরে কীভাবে মিলল জিনোম রহস্যের সমাধান
এই গবেষণায় বিজ্ঞানীরা একটি নতুন এবং শক্তিশালী প্রযুক্তি ব্যবহার করেছেন। পুরাতন যন্ত্রগুলো ডিএনএর ছোট ছোট অংশ পড়তে পারত। কিন্তু নতুন প্রযুক্তি ব্যবহার করে বিজ্ঞানীরা ডিএনএর অনেক লম্বা লম্বা অংশ একবারে পড়ার সুযোগ পেয়েছেন। এতে বিভিন্ন জিন বা ডিএনএর নানা অংশ একসঙ্গে মিলে কী ধরনের কাজ করেন, তা বোঝা সহজ হয়েছে। এ জন্য তাঁরা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের ৬৫ জন মানুষের ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ করেছেন। এরপর সেগুলো নিয়ে গবেষণা করে প্রত্যেক ব্যক্তির জিনের দুটি অনুলিপি তৈরি করেছেন। তারপর দেখেছেন, এই ডিএনএর কোন অংশে কী বলা আছে, কোন সংকেত বা জিনের অর্থ কী।
গবেষণায় নতুন কী কী পাওয়া গেল
এই গবেষণায় বিজ্ঞানীরা প্রায় ২ হাজারের বেশি নতুন ও জটিল ধরনের জিনের পরিবর্তন খুঁজে পেয়েছেন। এগুলো সম্পর্কে আগে তাঁরা জানতেন না। পাশাপাশি ১২ হাজারের বেশি এমন জিন খুঁজে পেয়েছেন, যেগুলো ডিএনএর ভেতর এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় লাফিয়ে যেতে পারে। ক্রোমোজোমের মাঝখানে সেন্ট্রোমিয়ার নামে একটি অংশ থাকে। এই সেন্ট্রোমিয়ার কোষ বিভাজনের জন্য খুব জরুরি। বিজ্ঞানীরা ১ হাজার ২০০টিরও বেশি সেন্ট্রোমিয়ারের সম্পূর্ণ মানচিত্র তৈরি করেছেন। এ ছাড়া তাঁরা অ্যামাইলেজ নামে একটি জিনের রহস্যও ভেদ করেছেন। আমরা ভালোভাবে কতটা স্টার্চ তথা ভাত-রুটির মতো খাবার হজম করতে পারি, তা বোঝা যাবে এর সাহায্যে।
ডিএনএর সম্পূর্ণ মানচিত্র
আগের জিনোম মানচিত্রটি ইউরোপের মানুষদের ডিএনএ দিয়ে তৈরি হয়েছিল। ফলে আফ্রিকা, এশিয়া বা দক্ষিণ আমেরিকার মানুষদের জন্য সেই মানচিত্রটি পুরোপুরি সঠিক ছিল না। এই নতুন গবেষণায় বিভিন্ন দেশের মানুষদের ডিএনএ ব্যবহার করায়, এখন আমাদের কাছে একটি সম্পূর্ণ মানচিত্র আছে। মানে এই মানচিত্র সব মানুষের জন্যই অনেক বেশি কার্যকর হবে।
ভবিষ্যতের সম্ভাবনা
এই আবিষ্কারের কারণে ভবিষ্যতে মানুষ বেশ কিছু সুবিধা পাবে। যেমন দ্রুত ও সহজে প্রায় ১০০টি রোগ নির্ণয় করা যাবে। এমন ওষুধ ও চিকিৎসা পদ্ধতি তৈরি করা যাবে, যা সব অঞ্চলের মানুষের জন্য সমানভাবে কাজ করবে। পাশাপাশি চিকিৎসায় খরচ কমবে। আগে একটি সম্পূর্ণ জিনোম সিকোয়েন্স করতে অনেক টাকা লাগত। কখনো সেটা ছাড়িয়ে যেত কোটির ঘর। এখন প্রযুক্তি এত সহজলভ্য হয়ে গেছে যে এই খরচ লাখের ঘরে নেমে এসেছে। হয়তো ভবিষ্যতে এমন দিন আসবে, যখন হাসপাতালে সবাই কম খরচে জিনোম পরীক্ষা করতে পারবে।
সূত্র: আর্থ ডটকম