অধ্যাপক ডাঃ নাজমুল হাসান-
এক।
১৯৪৭ সালের ১৪ই আগস্ট পাকিস্তান স্বাধীনতা লাভ করে বিধায় এটি পাকিস্তানের স্বাধীনতাদিবস। পাকিস্তানের স্বাধীনতাদিবস উপলক্ষ্যে ২০০০ সালের ১৪ই আগস্ট পুরাতন ঢাকার আরমানিটোলায় জাহাঙ্গীর আদেলের বাড়িতে দিনব্যাপী পাকিস্তানের পতাকা উড়ানো হয়। জাহাঙ্গীর আদেল ছিলেন কুখ্যাত রাজাকার মোনায়েম খানের মেয়ের জামাই। পাকিস্তানপ্রীতির জন্যই সে পাকিস্তান দিবসে স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে নিজের বাড়িতে পাকিস্তানের জাতীয় পতাকা উড়িয়েছিল।
স্থানীয় জনসাধারণের মধ্যে ঘটনাটি ব্যাপক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে এবং তারা এর বিরোধীতা করে। স্থানীয় আওয়ামী লীগের লোকজন ক্ষোভে ফেটে পড়ে। আরমানিটোলায় ৬৭ নং ওয়ার্ডের সভাপতি কামাল হোসেনের নেতৃত্বে স্থানীয় আওয়ামী লীগ ওই ঘৃণ্য ঘটনার তীব্র প্রতিবাদ জানায়।
ঠিক পরের দিন অর্থাৎ ১৫ই আগস্ট, জাতীয় শোক দিবসের অনুষ্ঠান শেষে বাড়ি ফেরার পথে জাহাঙ্গীর আদেলের দুই পুত্র জুবায়েদ আদেল ও তারেক আদেল দুজনে কামাল হোসেনকে গুলি করে হত্যা করে। তারা কামাল হোসেনের বুকে ও পেটে ১৩টি গুলি করে তাঁর মৃত্যু নিশ্চিত করে।
আওয়ামী লীগ নেতা কামাল হোসেনের মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়লে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের মানুষের মধ্যে তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কামাল হোসেন হত্যাকাণ্ডে ক্ষোভ প্রকাশ করেন এবং হত্যাকাণ্ডে জড়িত অপরাধীদের শনাক্ত করে খুনিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদানের নির্দেশ দেন (দৈনিক জনকণ্ঠ, ১৮ আগস্ট ২০০০)। আদালতে মামলা হয়।
২০০১ সালে বিএনপি-জামাত জোট ক্ষমতায় আসার পর ২০০৩ সালের আগস্ট মাসেই কামাল হোসেন হত্যা ও রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা থেকে নিম্ন আদালত মামলার সকল আসামিকে বেকসুর খালাস দেয়। তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনা সেই রায়ের প্রতিবাদে ক্ষোভ প্রকাশ করেন। তিনি বলেন- সরকার কার্যকর পদক্ষেপ না নেয়ায় আওয়ামী লীগ নেতা কামাল হোসেন হত্যা মামলার সকল আসামি রেহাই পেয়েছে। শেখ হাসিনা তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াকে উদ্দেশ্য করে বলেন- উনি কি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী নাকি পাকিস্তানের পদলেহনকারী (দৈনিক জনকন্ঠ, ২রা আগস্ট ২০০৩)।
শেখ হাসিনার প্রতিবাদে মরহুম কামাল হোসেনের ভাইয়ের পরিবার আশায় বুক বাঁধে। বুকভরা আশা নিয়ে তারা আওয়ামী লীগের ক্ষমতায় আসার অপেক্ষা করে। তাদের আশা, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসলে হত্যাকারীদের দৃষ্টান্তমূলক বিচার হবে, তাঁরা ন্যায়বিচার পাবে।
২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে এবং একটানা প্রায় ১৬ বছর ক্ষমতায় থাকে। এই ১৬ বছর কামাল হোসেনের ছোটভাই নাজির হোসেন তাঁর ভাইয়ের হত্যার ন্যায় বিচার পাবার জন্য আইন-আদালতের দ্বারস্থ হয়েছে। সুবিচারের আশায় আওয়ামী লীগ নেতাদের দ্বারে দ্বারে ঘুরেছে। আওয়ামী লীগের মন্ত্রী, স্থানীয় এমপি, দলীয় নেতা ইত্যাদি এমন কেউ নাই যার কাছে নাজির হোসেন সাহায্যের জন্য ধর্ণা দেয়নি। কিন্তু এই সুদীর্ঘ সময়ে আওয়ামী লীগ কামাল হোসেন হত্যার বিচার করেনি। নিহত পরিবারের কান্না আওয়ামী লীগ নেতাদের হৃদয়ে কোনো প্রকার অনুভূতি জাগায়নি।
শেখ হাসিনাও ক্ষমতায় গিয়ে কামাল হোসেনকে ভুলে যান। তিনি শুধু ভুলেই যাননি, তিনি তারেক আদেল ও জুবায়েদ আদেলকে হকি ফেডারেশনের দায়িত্ব দিয়ে পুরস্কৃত করেছেন। ফলে, বিএনপির আমল থেকে আওয়ামী লীগের আমলে কামাল হোসেনের হত্যাকারীরা অনেক দাপটের সাথে ভালো ছিল।
প্রচলিত আছে, জাহাঙ্গীর আদেলের দুই পুত্র বিপুল টাকা দিয়ে আওয়ামী লীগ নেতাদের কিনে পকেটস্থ করে। জনশ্রুতি আছে যে, বিক্রি হবার এই তালিকায় শেখ পরিবারের সদস্যদের মধ্যেও কেউ কেউ জড়িত ছিল, আরো জড়িত ছিল ওয়ামী লীগের মন্ত্রী, স্থানীয় এমপি এবং ক্রিকেট বোর্ডের সভাপতি পাপন। এদের প্রভাবে কামাল হোসেন হত্যাকাণ্ডের বিচার প্রভাবিত হয় এবং বিচারিক কার্যক্রম থেমে থাকে।
স্থানীয়ভাবে এ কথা চাউর হয় যে, অনেক টাকা ঢাললে আওয়ামী লীগ নেতাদের কেনা যায়। তারা বিক্রি হবার জন্যই খরচ-খরচা করে নেতা হয়। টাকা হাতে পেলে আওয়ামী লীগ নেতারা নীতি আদর্শ জলাঞ্জলি দিয়ে চোখ ওল্টাতে সময় নেয় না। কাকের মাংস কাকে খায় না, কিন্তু আওয়ামী লীগের মাংস আওয়ামী লীগে খায়। কখনো সোজা খায়, কখনো ঘুরিয়ে খায়।
সহোদরের হত্যাকাণ্ডের পর কামাল হোসেনের ছোটভাই নাজির হোসেন শপথ করেছিল, ভাই হত্যার বিচার না হওয়া পর্যন্ত তিনি বিয়ে করবেন না। নাজির হোসেন আজও বিয়ে করেননি। মামলার খরচ চালাতে গিয়ে কামাল হোসেনের পরিবার ঢাকা শহরের তিনটি বাড়ি বিক্রি করেছে। প্রভাবশালী অবস্থা থেকে প্রভাবহীন অবস্থায় নেমে এসেছে। কিন্তু নাজির হোসেন তাঁর ভাই হত্যার বিচার পায়নি।
আওয়ামী লীগ কামাল হোসেনের রক্তের সাথে বেইমানি করেছে। টাকার কাছে বিক্রি হয়েছে। আওয়ামী লীগ দলটির মধ্যে এমন হাজারও কামালের গল্প, হাজারো কামালের কান্না, দুঃখ, ক্ষোভ, ব্যাথা-বেদনা লুকিয়ে আছে। এসব পরিবারের শতসহস্র কর্মীর চোখে আওয়ামী লীগের নেতারা বেইমান, দলঘাতী, আদর্শ বিচ্যুত। এরা মুক্তিযুদ্ধের টিকিধারী ব্রাহ্মণ হলেও চর্চায় খন্দকার মোশতাকের আদর্শ ধারণকারী, সুযোগ পেলেই এরা মোস্তাক হয়ে ওঠে।
(মূল পোস্ট- আমিনুল ইসলাম। সরদার ফারুকের পোস্ট থেকে সংগৃহীত।)
দুই।
২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় এসে ১০০ দিনের কর্মসূচির নামে সারাদেশব্যাপী ব্যাপক সন্ত্রাসী কার্যক্রম চালায় এবং সংখ্যালঘু নির্যাতন করে। আওয়ামী লীগে ভোট দেবার অপরাধে মানুষকে মেরে-ধরে, ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ করে। নির্যাতনের শিকার মানুষগুলোকে মামলা পর্যন্ত করতে দেওয়া হয়নি।
তখন নির্যাতনের তীব্রতা এতো মারাত্মক ছিল যে, হাজার হাজার সংখ্যালঘু মানুষ নির্যাতনের জ্বালা সহ্য করতে না পেরে ভিটেমাটি ছেড়ে গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় খোলা আকাশের নিচে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়।
ওই সময়ে জামায়াত-বিএনপির দ্বারা যে পরিমাণ ধর্ষণ হয়েছিল তা ছিল একাত্তরের ধর্ষণযজ্ঞের চিত্রপট, একাত্তরের ধর্ষণের মিনি সংস্করণ। “বাবারা, তোমরা একজন একজন কোরে আসো, আমার মেয়েটা ছোট” একজন অসহায় মায়ের এ আর্তনাদ সৃষ্টির সময়কাল ছিল জামায়াত-বিএনপির ওই সময়ের শাসনকাল।
ওই নির্যাতন চলাকালীন আওয়ামী লীগ নেতা শেখ হাসিনা বলেছিলেন- আপনারা তালিকা কোরে রাখেন, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় গেলে এর প্রত্যেকটির বিচার হবে। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসেছিল, থেকেছিল কিন্তু তার একটিরও কার্যকর বিচার করেনি।
রাজনৈতিক বেনিফিটের জন্য আওয়ামী লীগের শাসনামলের পুরোটাই তারা জামায়াত-বিএপিকে দৌড়ের উপরে রেখেছিল কিন্তু নির্যাতকদের বিচার করেনি। আওয়ামী লীগের যতো বুলি, যতো কাজ সব নেতাদের ব্যক্তি স্বার্থ ও রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের জন্য করেছিল, কর্মীদেরকে মূল্যায়ন করেনি।
আওয়ামী লীগ দেশের জন্য অনেক ভালো কাজ করেছে, ব্যাপক উন্নয়ন করেছে, স্বাধীনতার পর এতো উন্নয়ন কখনো হয়নি। কিন্তু আওয়ামী লীগ এই উন্নয়ন কার্যক্রম করিয়েছে নির্দিষ্ট কিছু আওয়ামী লীগ নেতা, তাদের সাঙ্গপাঙ্গ ও অআওয়ামী লীগার ধান্দাবাজদের দ্বারা। ফলে, টাকার মালিক হয়েছে মুষ্টিমেয় সেই পৃষ্ঠপোষকতাপ্রাপ্ত মানুষগুলো, আওয়ামী লীগের তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মী, সমর্থক, শুভাকাঙ্ক্ষীদের ভাগে কিছু জোটেনি। এটাই আওয়ামী লীগের ধর্ম। এজন্য বলা হয়- আওয়ামী লীগ যখন জেতে তখন তারা একাই জেতে, কিন্তু যখন হারে তখন তারা সারা জাতিকে হারায়।
বঙ্গবন্ধু স্বাধীন দেশে ফেরার পরে তাঁর চারিদিক থেকে প্রকৃত আওয়ামী লীগারদের সরিয়ে অ-আওয়ামী লীগারদের বসিয়ে ছিলেন এবং তার পরিণতি আমরা জানি। শেখ হাসিনা একই কাজ করেছেন। শেখ পরিবারের ডালপালাগুলোকে মাথার উপরে উঠিয়ে নাচানো এবং তাদের দৌরাত্ম্যও আওয়ামী লীগ সমর্থকদের সাথে আওয়ামী লীগের দূরত্ব বাড়ায়।
তিন।
খুলনার দৌলতপুরে একটি সরকারি যায়গায় সরকারই দোকান তৈরি কোরে সরকারি বিধি মোতাবেক জনগণের কাছে তা বরাদ্দ দেয়। বরাদ্দপ্রাপ্তরা সরকারি অফিসে ভাড়া পরিশোধ কোরে দোকান চালায়। জাতীয় পার্টি এবং জামাত-বিএনপির সময়ে বরাদ্দপ্রাপ্তরা ওখানে কমবেশি ছহিসালামতে ব্যবসা-বাণিজ্য করছে। আওয়ামী লীগের সময়ে এসে শুরু হয় অনিয়ম। দুনিয়ার যতো চোর-ছ্যচ্ছড়, গাজাখোর-হেরোইনচিখোর, সমাজের মানুষের জীবন অতিষ্ঠকারী বদমাশ-বেয়াদবগুলো সব আওয়ামী লীগার হয়ে ওঠে এবং আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতা ও এমপির প্রত্যক্ষ পৃষ্ঠপোষকতায় দোকানগুলো অন্যায়ভাবে দখল করে নেয়। ওর মধ্যে আমার বড়ো ভাইয়েরও একটি দোকান ছিল। এই দোকানে তিনি একটি হস্তশিল্পের কারখানা চালাতেন। একসময়ে এই দোকানটির উপরে নির্ভরশীল ছিল আমাদের পুরো পরিবার। আমি মেডিকেল কলেজে পড়াকালীন এই দোকানের লাভ থেকেই আমার খরচ চলত।
আওয়ামী লীগের তখনকার স্থানীয় এমপি এবং মন্ত্রীর একমাত্র জামাই ছিল আমার বাল্যবন্ধু, তার মেয়ে ছিল আমার ভাবীর ক্লাসমেট। আগের থেকেই বাসায় যাতায়াত ছিল। আমরা আমাদের দোকানটা রাখার অনুরোধ নিয়ে অনেকবার এমপি’র কাছে গিয়েছি। গিয়েছে অন্য ভুক্তভোগীরাও। কোনো লাভ হয়নি, এমপির পৃষ্ঠপোষকতায় সবার দোকানই অন্যায়ভাবে দখল করে আওয়ামী লীগের ওইসব চোর-ছ্যচ্ছড়রা। আমরা মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সদস্য হলেও আওয়ামী লীগের চোর-ছ্যচ্ছড়দেরকে আওয়ামী লীগ যতটুকু মূল্যায়ন করেছে আমদেরকে ততটুকু মূল্যায়ন করা হয়নি। মূল্যায়ন কাউকেই করেনি, আইনকেও নয়- অন্যায়ভাবে সকলকে উচ্ছেদ করেছে।
আমার ভাবী খুলনার একটি কলেজের পার্টটাইম শিক্ষক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। ফুলটাইম নিয়োগের সময়ে আওয়ামী লীগের এমপির পৃষ্ঠপোষকতায় টাকার বিনিময়ে সমস্ত প্রটোকল ভেঙে সেই পজিশনে নতুন আরেকজনকে নিয়োগ দেওয়া হয়। অথচ ওই কলেজের তখনকার প্রিন্সিপাল ছিল আমার ঘনিষ্ঠ বাল্যবন্ধু। আমার সুদীর্ঘ কর্মজীবনের আওয়ামী লীগের শাসনামলের অংশটুকু সবচেয়ে খারাপ কেটেছে। এই ঘটনাটি আমি সেই সময়েও বিস্তারিত লিখেছি।
চার।
স্বার্থের জন্য চরিত্র বিসর্জন দিয়ে আত্মঘাতী হওয়া আওয়ামী লীগ নেতাদের বৈশিষ্ট্য। স্বার্থের জন্য নিজ দলের একজন ভালো মানুষ, ডাকসাইটে নেতার বিরুদ্ধে নিজেরাই কুৎসা রটিয়ে তাকে ভিলেন বানাতে এদের একটুও বাধে না। বড়ো থেকে ছোট এমন অগণিত উদাহরণ আওয়ামী লীগে আছে। আওয়ামী লীগ থেকে যতো নেতা আওয়ামী লীগ ছেড়ে গেছে এতো নেতার দল ছেড়ে যাবার ইতিহাস অন্য কোনো দলে নাই।
আওয়ামী লীগের সময়ে আওয়ামী লীগের নেতারা আদর্শের বুলি কপচিয়ে আওয়ামীপন্থী লোকজনের কাছ থেকে টাকা খায় না, কাজও করে না। অথচ টাকা খায় আওয়ামী বিরোধীদের কাছ থেকে এবং তাদের চাকরি ও সুযোগ-সুবিধা দেয়। এ কারণে জীবন দিয়ে আওয়ামী লীগ করা লোকজন, তৃণমূলের নেতা-কর্মী, সমর্থক-শুভাকাঙ্ক্ষীরা আহত হয়ে দল থেকে দূরে সরে যায়। আওয়ামী লীগের চরম বিপদে এরা মনের কষ্ট মনে চেপে রেখে দূরে সরে থাকে, রাজপথে নামে না। ক্ষুব্ধ হয়ে বলে- যাদের কাছ থেকে টাকা খেয়ে নেতা বানিয়েছেন, যাদেরকে সুবিধা দিয়ে টাকার কুমির বানিয়েছেন, তাদেরকে মাঠে নামান। সুবিধাবাদীরা মাঠে নামে না, মাঠ শূন্য থাকে- আওয়ামী লীগের পতন হয়। সুবিধাবাদীরা নিজ ঘরে ফিরে যায়, আবার মার খায় আওয়ামী লীগের তৃণমূলের নেতা-কর্মী, সমর্থক-শুভাকাঙ্ক্ষীরা। পঁচাত্তর ও চব্বিশ এর বড়ো দুটো উদাহরণ।
পাঁচ।
সমস্ত কাগজপত্র থাকার পরেও ঘুস না দেওয়ার কারণে আমার বাবাকে মুক্তিযোদ্ধার তালিকাভুক্ত করার সমস্ত চেষ্টা ব্যর্থ হয়। এ বিষয়ে আমি তখনও বিস্তারিত লিখেছি।
সমস্ত কাগজপত্র থাকার পরেও ঘুস না দেওয়ার কারণে আমার বাবাকে মুক্তিযোদ্ধার তালিকাভুক্ত করার সমস্ত চেষ্টা ব্যর্থ হয়
ছয়।
নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের জন্য স্বতঃস্ফূর্তভাবে তৈরি হওয়া গণজাগরণ মঞ্চকে একপর্যায়ে আওয়ামী লীগ ধারণ করে এবং পৃষ্ঠপোষকতা দেয়। কিন্তু রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের পর সেই গণজাগরণ মঞ্চকে আওয়ামী লীগ ছুঁড়ে ফেলে দেয়। এর সংগঠকদের গায়ে গু ছিটিয়ে দুর্গন্ধময় করে। আওয়ামী লীগের সময়েই এদের অনেকে জীবন বাঁচাতে দেশ ছাড়ে, অনেককে নানান অজুহাতে গ্রেফতার করে। বাকীদের খোঁজখবর পর্যন্ত নেয় না। আওয়ামী লীগের অফিসে গেলে তুচ্ছতাচ্ছিল্য কোরে অপমান করে। অথচ গণজাগরণ মঞ্চের অনলাইন এক্টিভিস্ট ও সংগঠকদেরকে পৃষ্ঠপোষকতা অব্যাহত রাখলে চব্বিশ তৈরি হতো না। আওয়ামী লীগের বুড়ো হাবড়া নেতাগুলো অনলাইনের গুরুত্বই বোঝে না। আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্রে এখনো তাতীলীগ আছে। হাস্যকর।
ইসলামি ব্যাংককের পর্ষদ পরিবর্তন করা ছিল গণজাগরণ মঞ্চের দাবি। অথচ সেই ইসলামি ব্যাংককে এস আলম গ্রুপের আওতায় দিয়ে দেয় আওয়ামী লীগ।
ইসলামি ব্যাংককের পর্ষদ পরিবর্তন করা ছিল গণজাগরণ মঞ্চের দাবি। অথচ সেই ইসলামি ব্যাংককে এস আলম গ্রুপের আওতায় দিয়ে দেয় আওয়ামী লীগ।
এস আলম কবে আওয়ামী লীগার ছিল? সালমান এফ রহমান কবে আওয়ামী লীগার ছিল? গণজাগরণ মঞ্চ করতে গিয়ে অনেকে চাকরি হারিয়েছে, ব্যাবসা বাণিজ্য হারিয়েছে। এদেরকে এই ব্যাংক থেকে কিছু কিছু ঋণ দিলেও এরা ঘুরে দাঁড়াতে পারতো। অথচ তা না কোরে এর পুরোটাই আওয়ামী লীগ এস আলমের পেটের মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়েছে। দূর দূর করে তাড়িয়েছে গণজাগরণ মঞ্চের কর্মীদের। মাঠ ফাঁকা করে মাথামোটা করেছে, শেষপর্যন্ত ওজন বইতে না পেরে চব্বিশ সৃষ্টি হয়েছে।
এমন নয় যে, এই ঘটনাগুলো আমি এখন বলছি। এর প্রত্যেকটি ঘটনা তখন আমি ফেসবুকে লিখেছি। আমার পারিবারিক ঘটনার বিষয়গুলো আমি জয় এবং পুতুলকে পর্যন্ত লিখে জানিয়েছি। কিচ্ছু হয়নি। এখনো আমার টাইমলাইনে সে লেখাগুলো আছে।
সাত।
মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাড়াতে গিয়ে একাত্তর দিয়ে একাত্তরকে ধর্ষণ করেছে আওয়ামী লীগ।
মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাড়াতে গিয়ে একাত্তর দিয়ে একাত্তরকে ধর্ষণ করেছে আওয়ামী লীগ।
কিসে চেতনা বাড়ে, আর কিসে চেতনার নামে মানুষ বিরক্ত হয় সে বিবেচনা করেনি। সমস্ত প্রতিষ্ঠানে বঙ্গবন্ধু কর্নার করা, সারা দেশব্যাপী বঙ্গবন্ধুর ম্যুরাল করার বিষয়গুলো হিতে বিপরীত হয়েছে। যাদের বুদ্ধিতে এগুলো কোরেছে তারা কিন্তু ফায়দা লুটে ভেগেছে, বিপদের সময়ে এটাকেও পাওয়া যায়নি।
আমি পরামর্শ দিয়েছিলাম- আওয়ামী লীগের অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের কমিটিতে মুক্তিযোদ্ধা বা তার পোষ্যদের জন্য কোটা রাখতে, সকল মুক্তিযোদ্ধার নামে এলাকার কোনো প্রতিষ্ঠানের নাম রাখতে, শহিদদের তালিকা করতে, বীরাঙ্গনাদের তালিকা করতে ইত্যাদি ইত্যাদি। সেটা কিন্তু করেনি। যা কোরেছে তারমধ্যে যতোটা না মুক্তিযুদ্ধকে ধরে রাখার প্রয়াস ছিল, তারচেয়ে বেশি প্রয়াস ছিল শেখ পরিবারকে উচ্চে ওঠানো। এটা মানুষ গ্রহণ করতে পারেনি। এ বিষয়ে তৃণমূলের আওয়াজ আওয়ামী লীগ কানে নেয়নি। আওয়ামী লীগ তার ক্ষমতার স্বার্থে ছাড়া তৃণমূলকে পোঁছেও না।
অগ্নিমত:
আওয়ামী লীগের নেতারা মুক্তিযুদ্ধের টিকিধারী ব্রাহ্মণ এবং এর কর্মীরা হলো শুদ্র। আওয়ামী লীগ ক্ষমতা নামক মন্দিরের পুরোহিত হবার পরে এদের কর্মীদের ছোঁয়া তাদের গায়ে লাগলেও যেন নেতাদের জাত যায়। কর্মীদের সাথে নেতাদের আচরণ এমন হয় যে, তুই আওয়ামী লীগ করতে পেরে ধন্য হয়েছিস, এজন্য আমাকে সালাম-সেলামি দুটোই দিবি কিন্তু কিছুই পাবি না। বাঘের গলার হাড় বের কোরে বকের যে অবস্থা হয়েছিল, আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় নেবার পর আওয়ামী লীগের নেতাদের কাছে আওয়ামী লীগের তৃণমূলের ওই অবস্থা হয়। নেতাদের ভাবটা হয় এমন- আওয়ামী লীগ করিস বলে আমার সাথে কথা বলতে পারছিস- এইই তোর পুরষ্কার।
নেতাদের ভাবটা হয় এমন- আওয়ামী লীগ করিস বলে আমার সাথে কথা বলতে পারছিস- এইই তোর পুরষ্কার।
৫ই আগস্টের পর থেকে আওয়ামী লীগের নেতারা পালিয়ে রয়েছে। এতোদিন চুপচাপ থাকলেও সুযোগ একটু অনুকূল মনে কোরে এখন অনেক নেতা অনলাইনে একটু-আধটু ঢু মেরে দুচারটে কথাও বলছে। এসব বক্তব্যের মধ্যে দোষারোপ আছে, অনুশোচনা নাই। এখন যারা অনলাইনে মূল লড়াইটা কোরে আওয়ামী লীগের জন্য অনুকূল অবস্থা তৈরি করছে তাদের মধ্যে আওয়ামী লীগের সময়ে সর খাওয়া খানেওয়ালা নেতারা কেউই নাই। আওয়ামী লীগের পক্ষে এখন সবচেয়ে বড়ো ভূমিকা পালন করছে আওয়ামীপন্থী অনলাইন এক্টিভিস্টরা, যারা আওয়ামী লীগের কাছ থেকে অসম্মান ছাড়া আগেও কিছু পায়নি, এখনো কিছু পাচ্ছে না, ভবিষ্যতেও কিছু পাবে না। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসলে এদেরকে বাদাড়ে ছুড়ে ফেলা হবে। সামনে আসবে শেখ পরিবার-ঘনিষ্ট ডালপালা, আবর্জনা এবং হাইব্রিড গং।
পালিয়ে থাকা আওয়ামী লীগ নেতারা এখনো দম্ভের সাথে অনলাইনে কথা বলছে। জনগণ এবং তৃণমূলের নেতা-কর্মী, সমর্থক-শুভাকাঙ্ক্ষীদের কাছে যে অন্যায় কোরেছে সে বিষয়ে কোনো অনুশোচনা প্রকাশ করছে না, ক্ষমা চাচ্ছে না। আমি এই ক্ষমা চাওয়া দেখার অপেক্ষায় আছি। ঘর শক্ত না হলে বাইরের কোনো শক্তি আওয়ামী লীগকে দেশের মাটিতে প্রতিষ্ঠিত করতে পারবে না।
পরাজিত হয়ে পালিয়ে যাবার কারণ তৃণমূলের কর্মীদের মাঠে না থাকা। কর্মীদের মূল্যায়ন না কোরে তাদের মনে আঘাত দিয়ে তাদেরকে দূরে সরিয়ে রাখার দায় নেতাদের। যদি শিক্ষা নিয়ে থাকেন তবে তৃণমূলকে ধারণ করেন। তৃণমূল ছাড়া আপনি অস্তিত্বহীন এ সত্য ধারণ করতে শিখুন। কায়মনে এটা চর্চা করুন।
উপসংহার:
কুকুর পৃথিবীর সবচেয়ে প্রভুভক্ত প্রাণী হবার পরেও ‘কুকুর’ একটি গালি। ‘কুকুর’ শব্দটি গালি হবার কারণ, কুকুরের স্বজাতিবিদ্বেষী স্বভাব। একটা কুকুর দূর দিয়ে যাওয়া আরেকটা কুকুরকে দেখলেও ঘেউ ঘেউ করে ওঠে। স্বজাতিবিদ্বেষী এই স্বভাবের কারণেই ‘কুকুর’ শব্দটি গালি হয়েছে। ফলে, স্বজাতিবিদ্বেষী হওয়া যাবে না, তাহলে কুকুরের সাথে মানুষের পার্থক্য থাকে না।
লেখকঃ কলামিস্ট এবং গবেষক