অধ্যাপক ডাঃ নাজমুল হাসান-
২২ ডিসেম্বর, রোববার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামে স্থানীয় পাতড্ডা বাজারে ওষুধ কিনতে গেলে স্থানীয় কয়েকজন জামাত-শিবির কর্মী, খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল হাই কানুকে ধরে কুলিয়ারা হাইস্কুলের সামনে নিয়ে যায় এবং তাঁর গলায় জুতার মালা পরিয়ে তাকে শারীরিক ও মানসিকভাবে হেনস্তা করে।
জামাত-শিবির কর্মীরা এ ঘটনার ভিডিও ধারণ করে এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় ১ মিনিট ৪৬ সেকেন্ডের একটি ভিডিও ফুটেজ ছাড়ে, যেটি ওই রাতেই ভাইরাল হয়।
এই ঘটনায় জেলা জামায়াত তাদের দুইজন কর্মীকে বহিষ্কার করে। চিফ অ্যাডভাইজারের প্রেস উইং থেকে এ ঘটনার নিন্দা জানানো হয় এবং অপরাধীদের আইনের আওতায় আনার জন্য বলা হয়। মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল হাই কানু যে ৯টি মামলার আসামি ছিলেন, চিফ অ্যাডভাইজারের প্রেস উইং সেটাও উল্লেখ করে।
মামলার আসামি থাকার বিষয়টি সত্য হলেও প্রেস উইংয়ের সেটি উল্লেখ করার বিষয়টি উদ্দেশ্য প্রণোদিত। মামলার বিষয়টিকে উল্লেখের মাধ্যমে অপরাধীদের অপরাধ লঘু ও গ্রহণযোগ্য করার চেষ্টা করা হয়েছে এবং মুক্তিযোদ্ধাদের বিষয়ে জনমনে অশ্রদ্ধার ভাব জাগানোর চেষ্টা করা হয়েছে বলে প্রতীয়মান। জামাত-শিবিরের যে কর্মীরা ঘটনাটি ঘটিয়েছে তাদের চরিত্রের বিষয়ে প্রেস উইং কিছু লেখেনি। সাধারণত যারা অপরাধ করে তাদের সম্পর্কে লেখা হয়, কিন্তু এক্ষেত্রে লেখা হয়েছে ভিক্টিম সম্পর্কে।
দেশে বহু বড়ো বড়ো ঘটনা ঘটে যাচ্ছে সে সব বিষয়ে প্রেস উইংকে সরব দেখা যায় না। যেমন- নির্বাচনী রোডম্যাপ ঘোষণা করা প্রেস উইংয়ের সবচেয়ে বড়ো দায়িত্ব। এটা তারা পালন করে না, উল্টো নির্বাচনের কথা জিজ্ঞেস করলে তাদের গায়ে জ্বালা ধরে যায়। গোঁজামেলে কথাবার্তা বলে। এ বিষয়ে এখন পর্যন্ত তারা গোঁজামিলের মধ্যেই আছে। অথচ এই বিষয়ে এরা মুখ খুলেছে। এটা যে ভালোবেসে নয়, বাধ্য হয়ে, সেটা বুঝতে বুদ্ধি খরচার দরকার পড়ে না।
মুক্তিযোদ্ধা হলেই যে তিনি ধোঁয়া তুলসীপাতা হবেন এমন কোনো কথা নাই। যেমন, শান্তির নোবেল পেলেই তিনি যে শান্তির কাজ করবেন এমন কোনো কথা নাই। মুক্তিযুদ্ধের সময়ে মুক্তিযুদ্ধ করেছেন, পরে অপরাধ করেছেন- অনাকাঙ্ক্ষিত হলেও এমনটা হতেই পারে, হচ্ছেও। যেমন, শান্তিতে নোবেল বাগানোর জন্য সে সময়ে লবিং কোরেছেন কিন্তু পরে শান্তির পায়রাকে রক্তাক্ত করেছেন- অনাকাঙ্ক্ষিত হলেও এমনটা হতেই পারে, হচ্ছেও। না, কোনো নির্দিষ্ট ব্যক্তির বিষয়ে বলছি না, একটা জেনারেল স্টেটমেন্ট দিচ্ছি। যেটা বলতে চাচ্ছি সেটা হলো- যে-ই অপরাধ করুক-না-কেন তা দেখার জন্য দেশের আইন-কানুন আছে, সেখানে সোপর্দ করা উচিত এবং সে অনুযায়ী চলা উচিত।
জুলাই-আগস্ট ম্যান্ডেটের দোহাই দিয়ে সারা দেশব্যাপী এভাবে নৈরাজ্য করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে যথেষ্ট অনাচার, নৈরাজ্য, হটকারী কাজকর্ম হয়েছে, যা অব্যাহত আছে। জুলাই-আগস্ট ম্যান্ডেট সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের কাছে ইতোমধ্যেই ব্যাকডেটেড হয়ে গেছে। ম্যান্ডেটের অতিব্যবহার এবং অপব্যবহারের কারণে ওটি এখন বুমেরাং এবং অটোফেজি ভূমিকায় ক্রিয়াশীল আছে। রাষ্ট্রীয় প্রটোকল ছাড়া জুলা-আগস্টের ম্যান্ডেটপ্রাপ্ত তথাকথিত বিপ্লবীরা জনগণের কাতারে যেতে পারছেন না। হায়েনার মতো দলবেঁধে ছাড়া চলাফেরা করতে ভয় পাচ্ছেন। এটা তাদের নিজেদের অপকর্মফল ছাড়া আর কিছু নয়।
প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই বিএনপি’র মধ্যে অনেক মুক্তিযোদ্ধা আছে। দলটির প্রতিষ্ঠাতাও একজন স্বনামধন্য মুক্তিযোদ্ধা যিনি সেক্টর কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তাঁর মুক্তিযুদ্ধের বীরত্বগাঁথা নিয়ে বিএনপি শুরু থেকেই গর্ব কোরে আসছে।
জামাত-শিবিরের বিষয়ে শুরু থেকেই বিএনপি’র অবস্থা ‘শ্যাম রাখি, না কুল রাখি’। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের লোকজনের সমর্থন ধরে রাখার জন্য মুক্তিযুদ্ধের দিকে এবং মুক্তিযুদ্ধ বিরোধীদের ধরে রাখার জন্য জামাত-শিবিরের দিকে, এমন একটা মাঝামাঝি অবস্থানে বিএনপি। দলটি আওয়ামী লীগ বিরোধীতা করে কিন্তু জামায়াত বিরোধীতা করে না। ফলে বিএনপিকে যতোটা মনে হয় মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের, ঠিক ততটাই মনে হয় মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষের। অবস্থানটা পরিস্কার করা উচিত। এটা সময়ের শক্ত দাবি।
বিএনপি’র এই দোটনা অবস্থানের কারণে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি বলতে মানুষ আওয়ামী লীগের উপরে ভরসা রাখতে শুরু করে। যদি তাই না হতো তবে পঁচাত্তরের পরে যে অবস্থা হয়েছিল তাতে আর আওয়ামী লীগের পক্ষে ঘুরে দাঁড়ানো সম্ভব হতো না। এটা অস্বীকার করার জো নাই যে, সমগ্র জাতির কাছে মুক্তিযুদ্ধ একটা ভক্তিশ্রদ্ধা ও আবেগের স্থান। হাতে গোনা কতগুলো স্বাধীনতা বিরোধী অমানুষ ছাড়া সর্বসমাজের কাছে মুক্তিযুদ্ধ এক, অদ্বিতীয় ও অস্পর্শী অর্জন। এটা জাতির মূল্যবোধ।
পঁচাত্তর পরবর্তী অবস্থায় যখন বিএনপি সৃষ্টি হয়েছিল তখন মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের এই শূন্য জায়গাটা যদি বিএনপি শক্তভাবে ধারণ করতে পারতো তবে পরবর্তীতে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে ফেরা কঠিন হয়ে যেতো। এই একাত্তর ও স্বাধীনতার কথা বলে বলেই পঁচাত্তরের পর আওয়ামী লীগ রাজনীতিতে পুনর্বাসিত হয়েছে।
পঁচাত্তরের মতো অতোটা খারাপ অবস্থা না হলেও চব্বিশে এসে আওয়ামী লীগ আবার ছিটকে পড়েছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার নামে যে অসাংবিধানিক সরকার দেশের ক্ষমতা দখল কোরে আছে, তারা আদা-জল খেয়ে একাত্তর ও স্বাধীনতা বিরোধী অবস্থান নেওয়ায়, একাত্তরকে ধারণ করার যায়গাটিতে আবার একটা শূন্যতা বিরাজ করছে। যদি এই শূন্যতা পূরণ না হয়, তবে এই অবস্থানকে কাজে লাগিয়ে আওয়ামী লীগ আবারও ফিরবে। ফলে একাত্তর ও মুক্তিযুদ্ধের এই অবস্থানটা যদি বিএনপি শক্তভাবে ধারণ কোরে এই শূন্যতা পূরণ করতে পারে তবে বিএনপিও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তিশালী দল হিসেবে জনমনে যায়গা কোরে নেবে। এরফলে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে ফিরে আসা কঠিন হয়ে যাবে।
বিএনপি সারা জীবন আওয়ামী লীগকে শত্রু ভাবলেও তার মূল শত্রু সবসময়েই ছিল জামায়াত। জামায়াত পরগাছার মতো বিএনপিকে জড়িয়ে ধরে রাজনীতিতে পুনর্বাসিত হবার সুযোগ নিয়েছে, তার নিজেরই স্বার্থে। বিএনপি জামাতকে নিয়েছে বন্ধু হিসেবে, জামাত বিএনপিকে নিয়েছে গাছ হিসেবে। জামাত-শিবিরের মতো একরোখা জনবিরোধী শক্তি কখনো কারো বন্ধু হয় না, হয় সুযোগসন্ধানী। দুই হাজার চব্বিশের জঙ্গি অভ্যুত্থানের পর মাইনাস টু ফর্মুলা বাস্তবায়নের পাঁয়তারা দেখে বিএনপি’র তা অনুধাবন করার কথা। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে থেকেই জামাতের এই চেহারা, ক্ষমতায় যেতে পারলে এই জামাত বিএনপিকে টুপ কোরে গিলে ফেলবে। আওয়ামী লীগ তো মাঠেই নাই।
আমার ধারণা এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে সরানোর জন্য বিএনপি এক সময়ে আওয়ামী লীগকে ডেকে মাঠে আনবে এবং এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের মতো যুগপৎভাবে ইউনূস সরকার বিরোধী আন্দোলন করবে। তাতে বিএনপি’র অস্তিত্ব থাকবে, কিন্তু জামায়াত ক্ষমতায় গেলে বিএনপি’রও অস্তিত্ব থাকবে না। জামাত নিজেকে ছাড়া সব খেয়ে ফেলবে।
জামাত-শিবির যতো সফল কাজই করুক-না-কেন, মুক্তিযুদ্ধকে পদদলিত করাকেই তারা তাদের সবচেয়ে বড়ো রাজনৈতিক সাফল্য হিসেবে দেখে। মুক্তিযুদ্ধকে অপমানের মাধ্যমে তারা তাদের সফলতা উদযাপন করতে চায়। মুক্তিযোদ্ধাকে জুতার মালা পরিয়ে অপমান করাটা ছিল তাদের সেই উদযাপনের প্রস্তুতি। এটা ছিল টেস্ট কেস, এটায় সফল হতে পারলে আরো ব্যাপকভাবে তারা এই অপমানের কাজটি করতো। জামাত-শিবির এটা পরিকল্পিতভাবে কোরেছে। জামায়াত ক্যাডারভিত্তিক দল, বিচ্ছিন্নভাবে এমন কাজ করার দল নয়। তাদের প্রতিটি পদক্ষেপ পরিকল্পিত।
স্থানীয় বিএনপি, মুক্তিযোদ্ধার এহেন অপমানের বিরুদ্ধে বিশাল মিছিল করেছে এবং এই জঘন্য ঘটনার শক্ত প্রতিবাদ করেছে। দোটনা রাজনীতির ধারা থেকে বেরিয়ে এসে শক্তভাবে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠার জন্য এটি বিএনপি’র একটি আশাব্যঞ্জক পদক্ষেপ। মানুষের মন জয় কোরে দীর্ঘমেয়াদে রাজনীতির মাঠে শেকড় গেড়ে টিকে থাকতে হলে মুক্তিযুদ্ধকে ধারণ কোরে টিকে থাকার রাজনৈতিক অবস্থানই মজবুত অবস্থান। এটাই প্রত্যাশিত।
নিজেদের খোলস পাল্টে জামায়াত-শিবির সকলকে সম্পৃক্ত কোরে, চোখে ধুলো দিয়ে জঙ্গি অভ্যুত্থান ঘটিয়েছে ঠিকই কিন্তু স্বাধীনতা বিরোধী অবস্থান নিয়ে তারা টিকে থাকতে পারবে না। বাংলাদেশের মানুষ স্বাধীনতা বিরোধীদের কোনো অবস্থায়ই মেনে নেবে না।
আওয়ামী লীগ এখন মাঠে নাই। ফলে একাত্তর ও স্বাধীনতার পক্ষের জায়গাটা অনেকটা শূন্য। বিএনপি শক্তভাবে এই শূন্যতা পূরণে কাজ করলে, মুক্তিযুদ্ধের সোল এজেন্ট হিসেবে আওয়ামী লীগের অবস্থান পিছিয়ে যাবে। রাজনীতির মাঠে সেটাই হবে বিএনপির জয় এবং স্থায়ী পূঁজি।
বিএনপি’র অনেক নেতাকর্মী গণজাগরণ মঞ্চে এসেছিল কিন্তু দলীয় অবস্থানের কারণে তারা কোনো দায়িত্ব নিয়ে সামনে আসতে পারেনি। এখনো বিএনপি’র সিংহভাগ নেতাকর্মী মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে। দলীয় দোটনা অবস্থানের কারণে বিএনপি’র অনেক নেতাকর্মী, সমর্থক, শুভাকাঙ্ক্ষী বুঝতেই পারে না, তাদের কতোটা আওয়ামী লীগ বিরোধীতা করা উচিত আর কতোটা জামাত-শিবির বিরোধীতা করা উচিত। আওয়ামী লীগের বিরোধীতা করতে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীতা কোরে ফেলানোর জন্যও বিএনপির এই রাজনৈতিক অস্পষ্টতা দায়ী।
বিএনপি যদি জামাত-শিবির ছেঁড়ে শক্তভাবে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ ধারণ কোরে এই শূন্যতা পূরণ কোরে এগিয়ে যায়, তবে তাদের নেতাকর্মী, সমর্থক, শুভাকাঙ্ক্ষীদের কাছেও নিজেদের অবস্থানও পরিষ্কার হবে। জনগণ সরকারি ও বিরোধী উভয় দলেই পাবে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি। এটাই প্রত্যাশিত, এটাই কাঙ্ক্ষিত এটাই গর্বের। এইই হোক।
লেখকঃ কলামিস্ট এবং গবেষক