অন্যান্য মতামত

‘বেগম রোকেয়া দিবস’ নারী জাগরণের এই পথিকৃৎ কে জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা।

শেখ মোহাম্মদ নাহিদঃ

নারী জাগরণের অন্যতম পথিকৃৎ বেগম রোকেয়া বাংলা সাহিত্যের একজন শক্তিশালী নারীবাদী লেখিকা।  শৈশবের সামান্য প্রাথমিক শিক্ষা ছাড়া কোনো আনুষ্ঠানিক শিক্ষা পাননি পরবর্তীতে স্বামীর অনুপ্রেরণায় সাহিত্যচর্চা শুরু করেন।

১৯০৯ খ্রিষ্টাব্দে স্বামীর নামানুসারে ভাগলপুরে প্রতিষ্ঠা করেন ‘সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস স্কুল’, যা ওই সময়কালে সাহসিকতার কাজ ছিলো। নারীদের কুসংস্কারমুক্ত ও শিক্ষিত করতে সমাজে প্রচলিত কুসংস্কারের বিরুদ্ধে তিনি কলম ধরেছিলেন। ‘অবরোধ বাসিনী’ তার পর্দাপ্রথা নির্ভর রচনা।

 সেই সময়ে নারীদের ঘরের এক কোণে পর্দার আড়ালে থাকাটাই ছিলো সামাজিক নিয়ম, নারীদের পড়াশুনা  করার অধিকার ছিলো না। বেগম রোকেয়া নিজের জীবনে এসব সামাজিক কুসংস্কারগুলোর মুখোমুখি হয়েছেন, মোকাবিলা করেছেন এবং তাই তিনি চাননি ভবিষ্যৎ প্রজন্মের মেয়েরা এসব কুসংস্কারের বলি হোক। মেয়েদের স্বাবলম্বী করার জন্য, সমাজের সমস্ত কুসংস্কারের বিরুদ্ধে মোকাবিলা করার জন্য আজীবন লড়াই করে গেছেন আজীবন। ‘অবরোধ বাসিনী’কে হাস্যরসাত্মক রচনা বলা হলেও হাসির বিপরীতে তিনি পর্দাপ্রথার নামে সমাজের সমস্ত অনিয়ম তুলে ধরেছেন সুচারুরূপে। বইটিতে ৪৭টি কাহিনি রয়েছে। কাহিনি বললে হয়ত ভুল হবে, কারণ এগুলো সত্য ঘটনা অবলম্বনে তৈরি এক-একটি জীবনের কথামালা।

পর্দাপ্রথার নামে ধর্মীয় কুসংষ্কারগুলোতে কুঠারাঘাতই ছিলো অবরোধবাসিনীর মূল লক্ষ্য। অবরোধ বাসিনী রচনাটি বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের ওই সময়কার নারীদের বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে লিখিত ঘটনার বর্ণনা।

রংপুর জেলার পায়রাবন্দ গ্রাম। আজ যে স্থানে আলো ছড়াচ্ছে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়। দিকে দিকে শিক্ষার বাতি হয়ে জ্বলছে। তার শুরুটা হয়েছি নিতান্তই এক খাঁচা-সম পরিবেশের মধ্যে দিয়ে। সময়টা ১৮৮০ খ্রিষ্টাব্দ। কঠোর পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীরা যখন অপসংস্কৃতির আর নারী বিদ্বেষী নিয়মের বেড়াজালে নারীরা বন্দী ছিলো, তখন বেগম রোকেয়া জন্মগ্রহণ করেন। যেখানে নারীদের কঠোর নিয়মের মধ্যে জীবন যাপন করতে হতো। জ্ঞান তৃষ্ণা পূরণ করাও তখন বেশ দুরূহ ছিলো। বেগম রোকেয়াকে নারী আন্দোলনের অগ্রদূত বলা হয়।

তিনি যে সময় জন্মগ্রহণ করেন সেসময় ইংরেজি শিক্ষা তো বহুদুরের কথা মেয়েদের শিক্ষা গ্রহণই ছিলো নিষেধ। মেয়েদের কাজ ছিলো সন্তান জন্মদান, লালনপালন ও গৃহ কাজকর্মের মধ্যে সীমাবদ্ধ। এমনকি নিজ পরিবারেও মতামত প্রকাশ করা ছিলো কঠিন কাজ। বাইরের জগতে বের হওয়ার সুযোগও ছিলো খুব কম। বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তিনি আবিষ্কার করলেন বাইরের পৃথিবীটা তার জন্য নয়। সেটা শুধুই পুরুষদের দখলে। তাকে ঘরেই আরবি ও উর্দু শিক্ষা দেয়া হলো। তবে জ্ঞানের নেশা যাকে পেয়ে বসে তাকে থামানো যায় না। বেগম রোকেয়ার বড় ভাই ইব্রাহীম ছিলেন আধুনিক মনষ্ক।

তিনিই বেগম রোকেয়াকে বাংলা ও ইংরেজি শেখান। তবে তা পরিবারের অন্য সদস্যদের অন্তরালে। নিজ পরিবারেই একাধারে ইংরেজি শিক্ষার বিরোধী থাকলেও বড় ভাইয়ের মতো আধুনিকমনষ্ক মানুষের সংস্পর্শে আসতে পেরেছিলেন। যে পরিবেশ বেগম রোকয়ার পরবর্তী জীবনে প্রতিষ্ঠিত হতেও ভূমিকা রেখেছিলো। আজ থেকে একশ বছরেরও বেশি সময় আগে বেগম রোকেয়া যে সাহসিকতা, উদার মনোভাব দেখিয়েছেন তা আজও নারীদের অগ্রযাত্রায় অনুসরণীয়, অনুকরণীয়। নারীরা যে কেবল ভোগের সামগ্রী নয় সে কথা তার রচনার মধ্যে দিয়ে তিনি বুঝিয়ে গেছেন। বেগম রোকেয়া তার চিন্তা চেতনা, তার ধ্যান-ধারণায় তখনকার নারীদের চেয়ে ছিলেন অনেক অনেক এগিয়ে। এমনকি এই আজ আধুনিক যুগে দাঁড়িয়েও অনেক নারী যখন তার অধিকারের কথা বলতে দ্বিধা করে তখন তিনি তার কর্ম দিয়ে দৃঢ় চেতনার পরিচয় দিয়েছেন।

বেগম রোকেয়ার অবরোধ বাসিনীর প্রতিটি ঘটনাই সেই সময়কার নারীদের সামাজিক অবস্থান, কঠোর পর্দা প্রথা, অশিক্ষা, কুসংস্কার, পুরুষতান্ত্রিকতা নির্মমতা প্রভৃতি বর্ণিত হয়েছে। ঘটনাগুলো পড়লেই পাঠক মাত্রই বুঝতে অসুবিধা হয় না এ রকম একটি প্রতিকূল পরিবেশে বেগম রোকেয়া নারী শিক্ষার আলো প্রজ্বলন করেছিলেন।

বেগম রোকেয়া অলঙ্কারকে দাসত্বের প্রতীক বিবেচনা করেছেন এবং নারীদের অলঙ্কার ত্যাগ করে আত্মসম্মানবোধে উজ্জীবিত হয়ে আর্থরাজনৈতিক স্বাধীনতা অর্জনে সচেষ্ট হতে আহ্বান জানিয়েছেন-

আমরা বহুকাল হইতে দাসীপনা করিতে করিতে দাসীত্বে অভ্যস্ত হইয়া পড়িয়াছি। ক্রমে পুরুষরা আমাদের মনকে পর্য্যন্ত দাস করিয়া ফেলিয়াছে।… তাহারা ভূস্বামী গৃহস্বামী প্রভৃতি হইতে হইতে আমাদের “স্বামী” হইয়া উঠিয়াছেন।… আর এই যে আমাদের অলঙ্কারগুলি– এগুলি দাসত্বের নিদর্শন। … কারাগারে বন্দিগণ লৌহনির্ম্মিত বেড়ী পরে, আমরা স্বর্ণ রৌপ্যের বেড়ী পরিয়া বলি “মল পরিয়াছি। উহাদের হাতকড়ী লৌহনির্ম্মিত, আমাদের হাতকড়ী স্বর্ণ বা রৌপ্যনির্ম্মিত “চুড়ি!”… অশ্ব হস্তী প্রভৃতি পশু লৌহশৃঙ্খলে আবদ্ধ থাকে, সেইরূপ আমরা স্বর্ণশৃঙ্খলে কণ্ঠ শোভিত করিয়া বলি “হার পরিয়াছি!”

বেগম রোকেয়া ১৮৮০ খ্রিষ্টাব্দের এইদিনে জন্মগ্রহণ করেন এবং ১৯৩২ খ্রিষ্টাব্দের এইদিনেই মৃত্যুবরণ করেন।

আজ বেগম রোকেয়া দিবস। নারী জাগরণের এই পথিকৃৎ এর জন্ম ও মৃত্যুবার্ষিকীতে জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা।

শেখ মোহাম্মদ নাহিদ- সাংবাদিক, সহ. সম্পাদক মাধ্যম২৪.কম

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।