গ্যাস নেই, উৎপাদন বন্ধ। গ্যাস সংকটে গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ, সাভার, আশুলিয়াসহ দেশের শিল্পাঞ্চলের অধিকাংশ কারখানাই এভাবে ধুঁকে ধুঁকে চলছে। উৎপাদন অর্ধেকে নেমে এসেছে। অনেক কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে।
গাজীপুরের শ্রীপুরের প্যারামাউন্ট টেক্সটাইল কারখানায় প্রায় সাড়ে ৪ হাজার শ্রমিক কাজ করছে। এখানেও গ্যাসের সংকট দেখা যাচ্ছে। কারখানার কাজ চালু রাখতে বিকল্প উপায় ব্যবহার করছে কর্তৃপক্ষ। উৎপাদন অব্যাহত রাখতে এলপিজি, ডিজেল ও সিএনজি গ্যাস ব্যবহার করা হচ্ছে এ কারখানায়। এতে মাসে প্রায় ৫ কোটি টাকা অতিরিক্ত খরচ করতে হচ্ছে মালিককে।
কারখানা মালিকরা বলছেন, উৎপাদন কমেছে, খরচ বেড়েছে। আয় কমে গেছে। শ্রমিকদের বেতন দিতে সমস্যা হচ্ছে। বড় ধরনের শ্রমিক অসন্তোষের আশঙ্কা করছেন তারা। যদিও নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহের কথা বলে গত বছরের শুরুতে শিল্পে গ্যাসের দাম রেকর্ড পরিমাণ ১৭৯ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানো হয়।
সংকট সমাধানে ব্যবসায়ীরা সরকারকে চিঠি দিয়েছেন। তবে সমস্যার আশু সমাধানের কোনো আশ্বাস পাচ্ছেন না তারা।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শিগগিরই গ্যাস সংকট দূর হবে না। কারণ দেশীয় গ্যাস অনুসন্ধানের চেয়ে আমদানিতেই সরকারের ঝোঁক বেশি। ফলে সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও দীর্ঘ দিন ধরে গ্যাস অনুসন্ধানে চরম অবহেলা করা হয়েছে। এদিকে উচ্চমূল্যের এলএনজি আমদানি করতে যে বিপুল পরিমাণ ডলার প্রয়োজন, তাও সরকারের হাতে নেই। ফলে সংকট আরও বাড়বে।
পেট্রোবাংলার কর্মকর্তারা জানান, দেশীয় গ্যাসের উৎপাদন কমতে থাকায় এমনিতেই দেশে সংকট। তার ওপর দুটি ভাসমান এলএনজি টার্মিনালের মধ্যে রক্ষণাবেক্ষণ কাজের জন্য একটি বন্ধ। এ মাসের মধ্যেই রক্ষণাবেক্ষণ শেষে টার্মিনালটি আবার চালু হবে। এর পর শুরু হবে দ্বিতীয় টার্মিনালের রক্ষণাবেক্ষণ। আগামী মার্চে এটি চালু হবে। তখন গ্যাস সরবরাহ বৃদ্ধির সক্ষমতা তৈরি হবে। কিন্তু অর্থ সংকটে গ্যাস আমদানি করা নিয়ে রয়েছে সংশয়।
মঙ্গলবার জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ সাংবাদিকদের বলেছেন, গ্যাসের সংকট রয়েছে। নিরবচ্ছিন্ন জ্বালানি সরবরাহ নিশ্চিত করতে পর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দ পাওয়া প্রয়োজন। তিনি বলেন, ২০২৬ সালের মধ্যে দেশে নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহে কাজ চলছে।
গাজীপুরে উৎপাদন নেমেছে অর্ধেকে
শ্রীপুরের প্যারামাউন্ট টেক্সটাইলের ব্যবস্থাপক (ইউটিলিটি) ফয়সালুর রহমান বলেন, গ্যাস সংকটের কারণে উৎপাদন ধরে রাখা যাচ্ছে না। বারবার শিপমেন্ট বাতিল করতে হচ্ছে। জাহাজের মাধ্যমে যে মাল রপ্তানি করার কথা, সেটা করতে হচ্ছে বিমানে।
এস এ স্পিনিং কারখানার জিএম নাজমুল আহসান বলেন, গ্যাসের চাপ যেখানে কমপক্ষে ১০ পিএসআই থাকতে হবে, সেখানে থাকছে ১-২ পিএসআই। কখনও আবার শূন্যের কোঠায় চলে আসে। চাহিদার ৩০ ভাগ গ্যাসও পাচ্ছি না। বসিয়ে বসিয়ে শ্রমিকদের বেতন দিতে হচ্ছে বলে জানান তিনি।
মহানগরের শিলমুন এলাকার ড্রিম টাচ ওয়াশিংয়ের মালিক খলিলুর রহমান বলেন, রাতে অল্প গ্যাস ও বিদ্যুৎ ব্যবহারে সামান্য উৎপাদন করা যাচ্ছে। কাজ না থাকায় কর্মীদের ছাঁটাই করে দিতে হচ্ছে।
মহানগরের টঙ্গী এলাকার বিএইচআইএস নামে পোশাক কারখানার অ্যাডমিন ম্যানেজার সাইফুর রহমান সোহাগ বলেন, ঠিকমতো গ্যাস না পাওয়ায় এলপিজি ও ডিজেল দিয়ে কারখানা চালানো হচ্ছে। এতে বাড়তি ব্যয় হচ্ছে। মাসের পর মাস গুনতে হচ্ছে লোকসান।
কালিয়াকৈরের মৌচাক এলাকার সাদমা ফ্যাশনের মহাব্যবস্থাপক রতন সরকার জানান, ছয় মাস ধরে গ্যাসের পর্যাপ্ত চাপ নেই। উৎপাদন অর্ধেকে নেমে এসেছে।
গ্যাসের চাপ না থাকায় সফিপুর আনসার একাডেমির সামনের গোমতি টেক্সটাইল মিলের উৎপাদন কমে গেছে। প্রতিষ্ঠানটির মহাব্যবস্থাপক নোয়ার হোসাইন বলেন, উৎপাদন ৫০ ভাগে নেমে এসেছে। সময়মতো পণ্য সরবরাহ করতে জাহাজের পরিবর্তে ৪ গুণ খরচে তা বিমানে পাঠাতে হচ্ছে। উপজেলার হরিণহাটি এলাকার এপেক্স ফুটওয়্যার কারখানায় দুই শিফটে সাড়ে পাঁচ হাজার শ্রমিক কাজ করে। গ্যাসচালিত জেনারেটরটি ডিজেল দিয়ে চালানো হচ্ছে। এতে উৎপাদন খরচ ১০-১৫ শতাংশ বেড়েছে।
নারায়ণগঞ্জে নেই মেশিনের শব্দ
নারায়ণগঞ্জের পুলিশ লাইন এলাকার রহমান নিট গার্মেন্টসে নেই মেশিনের শব্দ; নেই শ্রমিকদের কর্মচাঞ্চল্য। নিরাপত্তা প্রহরী সাইদুল জানান, গ্যাস না থাকায় কাপড় ডাইং হয়নি। ফলে কাটিং, সুইং, ফিনিশিং– সব বন্ধ। কারখানার মহাব্যবস্থাপক (ডাইং) নাহিদুল ইসলাম জানান, প্রতিদিন তাদের ৫ পিএসআই গ্যাস প্রয়োজন। তারা কয়েক দিন ধরে কোনো গ্যাসই পাচ্ছেন না। আগে রাতে গ্যাস পেলেও এখন তাও আসছে না। তাদের দেড় হাজার শ্রমিক বসে আছে।
তিনি জানান, তাদের গার্মেন্টে এখন যে কাজ চলছে, তা নভেম্বর মাসে পাঠানোর কথা ছিল। অথচ এখনও তারা পাঠাতে পারেননি। এ মাসে শিপমেন্ট না হলে মাল বিমানে পাঠাতে হবে বলে ক্রেতা জানিয়েছেন। আরেক ক্রেতা অর্ডার বাতিলের হুমকি দিয়েছেন।
বিকেএমইএর নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, ডলার ও অর্ডার সংকটের পর মজুরি বৃদ্ধির ধাক্কার মধ্যে গ্যাসস্বল্পতা পোশাক শিল্পের গলা টিপে ধরছে। সরকারের জরুরি পদক্ষেপ নেওয়া দরকার।
সরকারের অগ্রাধিকার ঠিক করতে হবে– তারা গ্যাসের ক্ষেত্রে সার কারখানা; নাকি গার্মেন্টকে গুরুত্ব দেবে। সার আমরা আমদানি করে প্রয়োজন মেটাতে পারি। কিন্তু গার্মেন্ট কারখানায় গ্যাস না দিলে এর বিকল্প কিছু নেই। কথা উঠতে পারে, সার আনতে ডলার লাগবে। গার্মেন্টে গ্যাস দিলে সার আমদানির চার গুণ ডলার আসবে।