চলতি বছর চিকিৎসাবিজ্ঞান ও শারীরতত্ত্বে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন মেরি ব্রাঙ্কো, ফ্রেড রামসডেল এবং শিমন সাগাগুচি। পেরিফেরাল ইমিউন টলারেন্স তথা শরীরের রোগ প্রতিরোধক কোষ জীবাণুদের আক্রমণ করতে গিয়ে যেন নিজের টিস্যু বা অঙ্গকে আক্রমণ না করে, সেই প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে গবেষণার জন্য তাঁদের এ পুরস্কার দেওয়া হয়।
বাংলাদেশ সময় সোমবার বিকাল ৩টা ৩০ মিনিটে সুইডেনের স্টকহোম থেকে এ বছরের চিকিৎসাবিজ্ঞানে নোবেল বিজয়ীদের নাম ঘোষণা করে ক্যারোলিনস্কা ইনস্টিটিউট।
নোবেলজয়ী এই বিজ্ঞানীরা পাবেন একটি মেডেল, একটি সনদপত্র এবং মোট ১১ মিলিয়ন বা ১ কোটি ১০ লাখ সুইডিশ ক্রোনা। বর্তমান বাজারে এর মান প্রায় ১২ লাখ মার্কিন ডলার, বাংলাদেশি মূদ্রায় প্রায় ১৪ কোটি ৬১ লাখ টাকা।
কেন এই পুরস্কার
প্রতিদিন আমাদের শরীর অসংখ্য জীবাণুর আক্রমণের শিকার হয়। এই আক্রমণ থেকে আমাদের রক্ষা করে শরীরের অতন্দ্র প্রহরী, রোগ প্রতিরোধতন্ত্র। সহজভাবে বলা যায়, দেহের নিরাপত্তাব্যবস্থা। নানা ধরনের হাজারো জীবাণু আক্রমণ করে আমাদের। এর কোনো কোনোটি আবার আমাদের দেহের কোষের রূপও নিতে পারে। অর্থাৎ ছদ্মবেশ ধারণ করতে পারে। তাদের সঠিকভাবে চিনে, নিজ শরীরের কোষকে আক্রমণ না করে রোগ প্রতিরোধ করে দেহের নিরাপত্তাব্যবস্থা। প্রশ্ন হলো, কীভাবে?
এ প্রশ্নের উত্তর মিলেছে এবারের চিকিৎসাবিজ্ঞান ও শারীরতত্ত্বে নোবেলজয়ীদের গবেষণায়। মেরি ব্রাঙ্কো, ফ্রেড রামসডেল ও শিমন সাকাগুচিকে দেহের নিরাপত্তাব্যবস্থার ‘প্রান্তিক সহনশীলতা’–বিষয়ক মৌলিক গবেষণার জন্য এ পুরস্কার দেওয়া হয়েছে। কথাটা শুনতে জটিল মনে হতে পারে। মূল বিষয় হলো, শরীরের নিরাপত্তাব্যবস্থার কোষগুলো নিজের টিস্যু বা অঙ্গকে আক্রমণ না করে কীভাবে জীবাণুদের সফলভাবে আক্রমণ করে, সে রহস্যই ভেদ করেছেন এই বিজ্ঞানীরা।
টি কোষের কথা
আমাদের দেহের নিরাপত্তাব্যবস্থা, যেকোনো দেশের সেনাবাহিনীর মতোই, সদা নির্ভীক, লড়াই করছে জীবাণুদের সঙ্গে। কিন্তু এরা আমাদের দেহকোষ এবং প্যাথোজেন বা জীবাণুদের মধ্যে পার্থক্য করে কীভাবে? বিজ্ঞানীরা ভাবতেন, এ প্রশ্নের উত্তর তাঁরা জানেন। সেন্ট্রাল ইমিউন টলারেন্স বা ‘কেন্দ্রীয় সহনশীলতা’ নামের একটি পদ্ধতির ভেতর দিয়ে যায় আমাদের কোষ। দেখা গেল, বিষয়টা এত সহজ নয়।
প্রতিটি টি কোষেই ‘টি-সেল রিসেপ্টর’ বা ‘টি কোষ গ্রাহক’ নামে বিশেষ ধরনের প্রোটিন থাকে। এরা একধরনের সেন্সরের সঙ্গে যুক্ত থাকে। এই সেন্সরই জীবাণু শনাক্ত করার মূল কারিগর। ‘টি কোষ গ্রাহক’ আবার নানা আকার-আকৃতির হতে পারে। জিগস পাজলের বিভিন্ন অংশের মতো। তাত্ত্বিকভাবে আমাদের দেহে বিপুল ধরনের বৈচিত্র্যময় টি কোষ তৈরি হতে পারে, তাদের থাকে আবার নানা আকারের গ্রাহক। এই আকার-আকৃতি গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এরা বিভিন্ন প্রকারের ভাইরাসের আকৃতি শনাক্ত করতে পারে। সমস্যা হলো, শরীরে এমন কিছু গ্রাহক টি কোষ তৈরি হয়, যেগুলো দেহের নিজস্ব টিস্যুর সঙ্গেও যুক্ত হতে পারে। ঘুরেফিরে তাই সেই প্রশ্ন—এরা তাহলে কেন শুধু জীবাণুদেরই আক্রমণ করে?
এর কারণটি বিজ্ঞানীরা বুঝতে পারেন ১৯৮০-এর দশকে। তাঁরা দেখেন, টি কোষ একধরনের পরীক্ষার মধ্য দিয়ে যায়। পরীক্ষাটি ঘটে থাইমাস নামে নিরাপত্তাব্যবস্থার একটি বিশেষ অঙ্গের ভেতরে। এই অঙ্গের ভেতরেই রোগ প্রতিরোধক কোষগুলো পরিপক্বতা লাভ করে। সেখানে থাইমাস এসব টি কোষকে দেহের নিজস্ব প্রোটিনের কিছু অংশ দেখায়। যেসব টি কোষ এসব প্রোটিনের অংশকে চিনতে পারে এবং সেগুলোর সঙ্গে যুক্ত হয়, সেগুলোকে ওখানেই ধ্বংস করে ফেলা হয়। আর যেগুলো আমাদের প্রোটিনকে চেনে না, ওগুলো বেঁচে যায়। তার মানে, এগুলো ভবিষ্যতে ভুলভাবে আমাদের নিজস্ব টিস্যু বা অঙ্গকে আক্রমণ করবে না। শুধু জীবাণুদেরই আক্রমণ করবে। এটাই সেই সেন্ট্রাল ইমিউন টলারেন্স বা কেন্দ্রীয় সহনশীলতা। বিজ্ঞানীরা ভেবেছিলেন, ঘটনা এটুকুই। কিন্তু ১৯৯৫ সালে শিমন সাকাগুচির হাত ধরে প্রথম বোঝা গেল, ঘটনা এত সহজ নয়।
নোবেলজয়ী গবেষকদের কাজ
১৯৯৫ সালে শিমন সাকাগুচি স্রোতের বিপরীতে গিয়ে প্রথম গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কারটি করেন। তিনি দেখান, দেহের রোগ প্রতিরোধতন্ত্র বা নিরাপত্তাব্যবস্থা আরও জটিল।
সাকাগুচির সহকর্মীরা নবজাত ইঁদুর নিয়ে একটি পরীক্ষা করেছিলেন। দেখা গেল, নবজাতক ইঁদুরের শরীর থেকে জন্মের তিন দিন পর থাইমাস অঙ্গটি সরিয়ে ফেললে ইঁদুরগুলোর দেহের নিরাপত্তাব্যবস্থা ভেঙে পড়ে। ফলে তারা বিভিন্ন অটোইমিউন রোগে আক্রান্ত হয়। অটোইমিউন রোগ মানে দেহের নিরাপত্তাব্যবস্থার প্রতিরক্ষীরা নিজেই নিজ দেহের কোষকে আক্রমণ করার ফলে যেসব রোগ হয়। তো, এর সমাধান কী? দেখা গেল, পরে যদি সেই ইঁদুরগুলোর শরীরে অন্য কোনো সুস্থ ইঁদুরের পরিণত টি কোষ প্রবেশ করানো হয়, তবে তাদের নিরাপত্তাব্যবস্থা আবার সক্রিয় হয়ে ওঠে এবং ওই রোগগুলোকে প্রতিরোধ করতে পারে।
এ থেকে সাকাগুচি সিদ্ধান্তে আসেন, টি কোষেরই এমন কোনো বিশেষ দল আছে, যারা সুবিবেচক নিরাপত্তারক্ষীর মতো কাজ করে এবং অন্য টি কোষগুলোকে শান্ত রাখে। প্রায় এক দশকের গবেষণার পর, ১৯৯৫ সালে তিনি এই কোষগুলোকে শনাক্ত করেন। এগুলোর নাম দেওয়া হয় নিয়ন্ত্রক টি কোষ (Regulatory T cells)। সাকাগুচি দেখান, এই নিয়ন্ত্রক টি কোষগুলোর পৃষ্ঠে CD4 এবং CD25 নামে দুটি বিশেষ প্রোটিন থাকে।
স্বাভাবিকভাবেই বিশ্বের বেশির ভাগ বিজ্ঞানী এ কথা মানতে চাননি। তাঁরা আরও প্রমাণ চান। সেই প্রমাণ পাওয়া যায় নোবেলজয়ী বাকি দুই গবেষকের হাত ধরে।
যুক্তরাষ্ট্রে মেরি ব্রাঙ্কো ও ফ্রেড রামসডেল ‘স্কার্ফি’ নামে বিশেষ এক জাতের ইঁদুর নিয়ে গবেষণা করছিলেন। এই ইঁদুরগুলোর পুরুষ শাবকেরা এক ভয়ংকর অটোইমিউন রোগে আক্রান্ত হয়ে কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই মারা যেত। বিজ্ঞানীরা বুঝতে পারছিলেন, এর কারণ ইঁদুরের এক্স (X) ক্রোমোজোমে থাকা একটি ত্রুটিপূর্ণ জিন।
ব্রাঙ্কো ও রামসডেল সেই যুগে দাঁড়িয়ে এক প্রায় অসম্ভব কাজে হাত দেন—এক্স ক্রোমোজোমের প্রায় ১৭ কোটি বেজ পেয়ারের মধ্য থেকে সেই একটিমাত্র ত্রুটিপূর্ণ জিনকে খুঁজে বের করার সিদ্ধান্ত নেন তাঁরা। বছরের পর বছর অক্লান্ত পরিশ্রমের পর তাঁরা সফল হন ২০০১ সালে। নিজেদের আবিষ্কৃত এই জিনের নাম দেন ফক্সপি৩ (Foxp3)। তাঁরা আরও প্রমাণ করেন, মানুষের এই একই জিনে জিনগত পরিবর্তন ঘটলে আইপেক্স (IPEX) নামে এক বিরল অটোইমিউন রোগ দেখা দেয়।
এর দুই বছর পর, ২০০৩ সালে, শিমন সাকাগুচি এই দুটি আবিষ্কারের মধ্যে সম্পর্ক স্থাপন করেন। তিনি প্রমাণ করেন, এই ফক্সপি৩ (Foxp3) জিনটিই ১৯৯৫ সালে তাঁর চিহ্নিত কোষগুলোর বিকাশ নিয়ন্ত্রণ করে। আগেই বলেছি, এই কোষগুলো বর্তমানে রেগুলেটরি টি সেল (Regulatory T cells) বা নিয়ন্ত্রক টি কোষ নামে পরিচিত। অন্য রোগ প্রতিরোধক কোষকে পর্যবেক্ষণ ও নিয়ন্ত্রণ করে এই কোষগুলো নিশ্চিত করে, আমাদের দেহের নিরাপত্তাব্যবস্থা যেন আমাদের নিজের টিস্যুগুলোর প্রতি সহনশীল থাকে। অর্থাৎ নিজেই নিজেকে আক্রমণ না করে। এরই নাম দেওয়া হয়েছে পেরিফেরাল অটোইমিউন টলারেন্স বা প্রান্তিক সহনশীলতা। অর্থাৎ এরা আমাদের সেকেন্ড লাইন অব ডিফেন্স। কেন্দ্রীয় সহনশীলতার পরের ধাপে এরা নিশ্চিত করে, ওই ছাঁকনি পেরিয়ে এসেও কোনো টি কোষ যেন ভুলক্রমে আমাদের দেহের কোনো টিস্যু বা অঙ্গকে আক্রমণ না করে।
নোবেল বিজয়ীদের এই গবেষণাগুলোর মধ্য দিয়ে রোগ প্রতিরোধতন্ত্রের প্রান্তিক সহনশীলতা গবেষণাক্ষেত্রের সূচনা হয়। ক্যানসারসহ বেশ কিছু অটোইমিউন রোগের চিকিৎসা উন্নয়নে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে তাঁদের গবেষণা। এটি ভবিষ্যতে সফল অঙ্গ প্রতিস্থাপনেও সহায়ক হতে পারে। এ–সংক্রান্ত বেশ কিছু গবেষণা বর্তমানে ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল পর্যায়ে রয়েচজে।
লিখেছেন:
মাহিয়া আহমেদ
মাস্টার্স গ্রাজুয়েট, ইন্টারন্যাশনাল মাস্টার্স ইন সাসটেইনেবল ড্রাগ ডিসকভারি, ঘেন্ট ইউনিভার্সিটি, মেডিক্যাল ইউনিভার্সিটি অব গাদানস্ক, ইউনিভার্সিটি অব গ্রোনিংগেন, ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া সান ফ্রান্সিসকো