রাজধানী সাতটি সরকারি কলেজ নিয়ে প্রতিষ্ঠা করা হচ্ছে ঢাকা সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটি। সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয়টি স্থাপনে খসড়া অধ্যাদেশ জারি করা হয়েছে। অধ্যাদেশ চূড়ান্ত হলে বিশ্ববিদ্যালয়টির আনুষ্ঠানিক শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হবে। তবে ইতোমধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়টির শিক্ষা কার্যক্রম চলছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অধিভুক্তির মাধ্যমে বিদ্যমান কাঠামোতে।
এই বিশ্ববিদ্যালয়টি দেশের অন্যান্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো হলেও কিছুটা ভিন্নতা রয়েছে। আন্তর্জাতিক মানের বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মতো ডিসিপ্লিন পরিবর্তনের সুযোগসহ কিছু বাড়তি সুযোগ রাখা হয়েছে খসড়ায়। তবে পুরোপুরি স্বায়ত্তশাসন নেই ঢাকাসহ ১৯৭৩ সালের অধ্যাদেশে পরিচালিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মতো।
বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন মনে করছে, শিক্ষার্থীদের জন্য সব ধরনের সুযোগ-সুবিধার কথা বিবেচনা করেই আধুনিক মানের বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবে এই বিশ্ববিদ্যালয়টি।
শিক্ষার্থীদের দাবির মুখে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অধিভুক্ত রাজধানীর সাতটি সরকারি কলেজ- ঢাকা কলেজ, ইডেন মহিলা কলেজ, সরকারি শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ, কবি নজরুল সরকারি কলেজ, বেগম বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজ, সরকারি বাঙলা কলেজ ও সরকারি তিতুমীর কলেজ নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ঘোষণা করে। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সদস্য (ইউজিসি) অধ্যাপক মোহাম্মদ তানজীমউদ্দিন খানের নেতৃত্ব একটি খসড়া অধ্যাদেশ প্রস্তুত করা হয়। গত ২৪ সেপ্টেম্বর শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগ খসড়া অধ্যাদেশ অনলাইনে প্রকাশ করে। খসড়ায় মতামতের জন্য সময় দেওয়া হয় সাত দিন।
জানতে চাইলে ইউজিসি সদস্য অধ্যাপক মোহাম্মদ তানজীমউদ্দিন খান জানান, ‘খুব কম সময়ের মধ্যে আধুনিক মানের বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় অধ্যাদেশের খসড়া প্রস্তুত করা হয়েছে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা যেসব সুযোগ সুবিধা পান, সে ক্ষেত্রে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে বাড়তি বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। শিক্ষার্থীদের বিষয়টি মাথায় রেখে অধ্যাদেশের খসড়া করা হয়েছে। ঢাকা সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটিতে প্রথম টিচিং অ্যাসিটেন্ট নিয়োগের সুযোগ রাখা হয়েছে। ডিসিপ্লিন পরিবর্তনের সুযোগ রাখা হয়েছে।’
বিশ্ববিদ্যালয়টির একাডেমিক ও ভৌত কাঠামো
ঢাকা সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটির সাতটি ক্যাম্পাসে চলবে চারটি স্কুল। সাতটি কলেজ ক্যাম্পাসকে স্কুল অব সাইন্সেস, স্কুল অব আর্টস অ্যান্ড হিউম্যানিটিজ, স্কুল অব বিজনেস স্টাডিজ এবং স্কুল অব ল অ্যান্ড জাস্টিস বিভক্ত করে বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাডেমিক কার্যক্রম পরিচালিত হবে।
স্কুল অব আর্টস অ্যান্ড হিউম্যানিটিজ স্কুলটি সরকারি বাঙলা কলেজ ক্যাম্পাসে পরিচালিত হবে। স্কুল অব বিজনেস পরিচালিত হবে সরকারি তিতুমীর কলেজ ক্যাম্পাসে। স্কুল অব সাইন্সেস পরিচালিত হবে ঢাকা কলেজ ক্যাম্পাস, ইডেন মহিলা কলেজ ক্যাম্পাস ও বেগম বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজ ক্যাম্পাসে। স্কুল অব ল অ্যান্ড জাস্টিস পরিচালিত হবে কবি নজরুল সরকারি কলেজ ক্যাম্পাস ও সরকারি শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ ক্যাম্পাসে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের সাতটি একাডেমিক ক্যাম্পাস থাকবে, অর্থাৎ সাতটি কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাতটি ক্যাম্পাস হিসেবে পরিচিত হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবন, শিক্ষার্থী-শিক্ষক কেন্দ্র, অডিটোরিয়াম এবং স্বাস্থ্য কেন্দ্র একটি স্বতন্ত্র স্থান থেকে পরিচালিত হবে।
বিশ্ববিদ্যালয়টি একটি ইন্টারডিসিপ্লিনারি বিশ্ববিদ্যালয় হবে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের আওতাভুক্ত ঢাকা মহানগরের সরকারি সাত কলেজের শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংশ্লিষ্ট ক্যাম্পাসের পরীক্ষাগারসহ অন্যান্য সমজাতীয় সুযোগসুবিধা প্রয়োজনে শর্তসাপেক্ষে ব্যবহার করতে পারবেন।
হাইব্রিড বিশ্ববিদ্যালয়
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাদান পদ্ধতি হাইব্রিড পদ্ধতিতে পরিচালিত হবে। শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে ৩৫% এবং ভার্চুয়াল পদ্ধতিতে হবে ৪০%। তবে সব পরীক্ষা সশরীরে অনুষ্ঠিত হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা পদ্ধতি ইন্টারডিসিপ্লিনারি হবে, কোনও একটি স্কুলের স্নাতক পর্যায়ের প্রথম চারটি সেমিস্টারে সাধারণ বিষয়গুলো অধ্যয়ন করবে। পরবর্তী চারটি সেমিস্টারের বিষয়গুলো ডিসিপ্লিনভিত্তিক হবে। স্নাতক পর্যায়ের কোনও শিক্ষার্থীর চাহিদার ভিত্তিতে প্রথম চারটি সেমিস্টার সমাপান্তে শর্তপূরণ সাপেক্ষে শুধু নিজ ক্যাম্পাসেই ডিসিপ্লিন পরিবর্তনের সুযোগ দেওয়া যাবে।
বিকালে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম
খসড়ার বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন সংক্রান্ত অনুচ্ছেদে বলা হয়, ঢাকা মহানগরের ঢাকা কলেজ, ইডেন মহিলা কলেজ, সরকারি তিতুমীর কলেজ, সরকারি বাঙলা কলেজ, বেগম বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজ, সরকারি শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ ও কবি নজরুল সরকারি কলেজ এই সাতটি কলেজের অবকাঠামো ও ক্যাম্পাস স্থায়ীভাবে দিনের নির্দিষ্ট সময়ের জন্য দুপুর ১টা থেকে সন্ধ্যা ৭টায় ব্যবহার করে বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম পরিচালিত হবে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে অধ্যাপক মোহাম্মদ তানজীমউদ্দিন খান বাংলা বলেন, ‘সাতটি কলেজের ক্যাম্পাসে বিশ্ববিদ্যালয়টির শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালিত হবে। কলেজের উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের শিক্ষা কার্যক্রম বেলা ১২টার মধ্যেই শেষ হয়ে যাবে। তাদের জন্য সময় রেখে বিকালে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করা হবে। দুপুর ১টা থেকে সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালিত হবে।’
বিশ্ববিদ্যালয় হওয়ার আগে উচ্চমাধ্যমিকের অবস্থান
ঢাকা সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটি প্রতিষ্ঠিত হওয়ার আগে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের কলেজগুলোর বিরাজমান পরিচয়, বৈশিষ্ট্য, অবকাঠামো ও অন্যান্য বিদ্যমান সুযোগ সুবিধা অক্ষুণ্ণ থাকবে। কলেজের ভৌত অবকাঠামোর যৌথ ব্যবহার, অবকাঠামোগত উন্নয়ন, সেবা কর্মীর যৌথ ব্যবহার এবং পানি, বিদ্যুৎ ও অন্যান্য সেবা সংক্রান্ত ব্যয়সহ বিভিন্ন প্রাসঙ্গিক বিষয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়, কলেজ কর্তৃপক্ষ ও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ত্রিপক্ষীয় চুক্তির ভিত্তিতে যৌথ ব্যবহার ও অংশীদারিত্ব নির্ধারিত হবে। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জরি কমিশন এই চুক্তি সম্পাদনের উদ্যোগ নেবে।
উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষা কার্যক্রম বিষয়ে জানতে চাইলে অধ্যাপক মোহাম্মদ তানজীমউদ্দিন খান বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনও রিসোর্স তৈরি হয়, তাহলে উচ্চমাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের তা ব্যবহার করতে দিতে হবে। তবে কলেজ প্রশাসনে আর বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন আলাদা থাকবে। কলেজ প্রশাসনের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কোনও সম্পর্ক নেই। তবে সাতটি কলেজের শিক্ষার্থীদের ভর্তিরে ক্ষেত্রে বাড়তি সুবিধা থাকবে। কারণ কলেজের কম্পাসগুলোতেই তো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম চলবে।’
শিক্ষক-কর্মচারী নিয়োগে ইউজিসির অনুমোদন লাগবে
বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের অনুমোদনক্রমে এবং নির্ধারিত শর্তে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রয়োজনে প্রভাষক, সহকারী অধ্যাপক, সহযোগী অধ্যাপক, অধ্যাপক, সুপারনিউমারারি অধ্যাপক ও ইমেরিটাস অধ্যাপকের পদসহ গবেষক ও কর্মচারীর যেকোনো পদ সৃষ্টি করা এবং সংশ্লিষ্ট সিলেকশন বোর্ড সুপারিশ করা ব্যক্তিবর্গকে উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের অনুমোদনক্রমে সেই সব পদে নিয়োগ দিতে হবে।
অধ্যাদেশে আর বলা হয়, কমিশনের অনুমোদনক্রমে ও নির্ধারিত শর্তে কোনও শিক্ষক বা গবেষক ও বিশেষজ্ঞকে চুক্তিভিত্তিক, খণ্ডকালীন বা অন্য কোনোভাবে নিয়োগের ক্ষেত্রে তাদের বেতন বা পারিশ্রমিক নির্ধারণ করা এবং কোনও বিদেশি নাগরিককে এই সব পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন নিতে হবে।
সাত কলেজ নিয়ে সংকট
উচ্চ মাধ্যমিকের শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় তাদের শিক্ষা সংকুচিত হয়ে পড়বে। শিক্ষার্থীরা উদ্বেগ জানিয়ে মঙ্গলবার (২৩ সেপ্টেম্বর) বদরুন্নেসার সরকারি কলেজের সামনের রাস্তায় সামনে স্মারকলিপি প্রদান ও অবস্থান কর্মসূচি পালন করেছে। আগের দিন সোমবার (২২ সেপ্টেম্বর) ঢাকা কলেজের উচ্চ মাধ্যমিকের শিক্ষার্থীরা উদ্বেগের কথা জানিয়েছেন সংবাদ সম্মেলন করে।
জানতে চাইলে অধ্যাপক মোহাম্মদ তানজীমউদ্দিন খান বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয় চলবে আলাদা প্রশাসনে। কলেজ চালাবে আলাদা প্রশাসন। কলেজ প্রশাসনের জন্য রয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়।’