সাম্য রাইয়ান–

বাঙলাদেশের সাংস্কৃতিক জীবন থেকে ফেব্রুয়ারি মাসকে বাদ দিয়ে কল্পনা করা যায় না। শহীদ দিবস, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস এবং অমর একুশে বইমেলা—সব মিলিয়ে ফেব্রুয়ারি হয়ে উঠেছে এক অনন্য প্রতীকময় সময়। অথচ বাংলা একাডেমি সম্প্রতি ঘোষণা করেছে, ২০২৬ সালের অমর একুশে বইমেলা শুরু হবে ১৭ ডিসেম্বর ২০২৫-এ এবং চলবে ১৭ জানুয়ারি ২০২৬ পর্যন্ত। অর্থাৎ, বইমেলাকে ফেব্রুয়ারি থেকে প্রায় দেড় মাস এগিয়ে আনা হচ্ছে। যুক্তি হিসেবে দেখানো হয়েছে দুটি কারণ—ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন এবং পবিত্র রমজান মাস।
এই দুটি কারণ কতটা গ্রহণযোগ্য? ইতিহাস খুঁজলে দেখা যায়, এর আগে তিনবার জাতীয় সংসদ নির্বাচন ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত হয়েছে—১৯৭৯ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি, ১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি এবং ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি। এর কোনো ক্ষেত্রেই বইমেলা নিয়ে এমন সিদ্ধান্ত হয়নি। কারণ, ভোট ও বইমেলা সাংঘর্ষিক নয়। বরং নির্বাচনের দিনটি ছুটির দিন হওয়ায় ভোট শেষে পরিবার-পরিজন নিয়ে বইমেলায় আসার মতো সুযোগও তৈরি হয়। নির্বাচনের কারণে বইমেলায় ভিড় কমবে—এমন ধারণা বাস্তব অভিজ্ঞতায় ভিত্তিহীন।
তাহলে এইবার হঠাৎ কেন নির্বাচনের দোহাই? আসলে যুক্তির চেয়ে এটা একটা সুবিধাজনক অজুহাত বলেই মনে হয়। সাংস্কৃতিক আয়োজনকে নির্বাচনের মতো রাষ্ট্রীয় কার্যক্রমের অধীনস্থ করার মানসিকতা সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য ও স্বাধীনতাকেই ক্ষুণ্ন করে। অমর একুশে বইমেলা শুধু একটি মেলা নয়; এটি ভাষা আন্দোলনের চেতনাকে বহনকারী সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য। এর সময়কে সরিয়ে দেওয়া মানে একপ্রকার ইতিহাসের ধারাবাহিকতাকেই ছেদ করা।
বাংলা একাডেমির দ্বিতীয় অজুহাত রমজান। বলা হচ্ছে, রোজার মাসে বইমেলা করা যাবে না। অথচ একটু ভেবে দেখলেই বোঝা যায়, রোজার মাসে বইমেলা চালানো কোনো অস্বাভাবিক বিষয় নয়। সন্ধ্যার পর ইফতারি শেষে পরিবার-পরিজন নিয়ে মেলায় যাওয়া অনেকের জন্য আকর্ষণীয় হয়ে উঠতে পারে। মেলায় অস্থায়ী মসজিদ থাকে, ফলে তারাবি নামাজ পড়ারও সুযোগ আছে। সাংস্কৃতিক চর্চাকে ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের সাথে সাংঘর্ষিক ভেবে আগেভাগে সরিয়ে ফেলা একধরনের আত্মসমর্পণ ছাড়া কিছু নয়।
তাহলে মূল প্রশ্ন দাঁড়ায়—কোন স্বার্থে বইমেলা ফেব্রুয়ারি থেকে সরিয়ে আনা হলো? ফেব্রুয়ারি মাসে একুশের শহীদ স্মৃতির আবহের সাথে যে প্রতীকী সম্পর্ক বইমেলার, সেটি ভেঙে দেওয়া কি একধরনের ঐতিহাসিক বিচ্ছিন্নতা সৃষ্টি করবে না? বইমেলাকে ডিসেম্বর-জানুয়ারিতে সরিয়ে নিলে তা হয়তো ক্যালেন্ডারের দিক থেকে সুবিধাজনক হবে, কিন্তু সাংস্কৃতিক ইতিহাস ও চেতনার দিক থেকে একে বলা যায় আত্মবিরোধী সিদ্ধান্ত।
বাংলা একাডেমি যদি সত্যিই বইমেলার আন্তর্জাতিক মান উন্নত করতে চায়, তবে প্রয়োজন হবে বই প্রকাশনা ও বিপণনের সুষ্ঠু পরিকল্পনা, লেখক-পাঠকের পারস্পরিক বিনিময়ের নতুন আয়োজন, এবং লেখক-পাঠকের জন্য আকর্ষণীয় উদ্যোগ। নির্বাচনের অজুহাত বা রোজার মাসের ভয়ে মেলার সময় পাল্টে দেওয়া কোনো সমাধান নয়। বরং এটি প্রমাণ করে, প্রতিষ্ঠানটি তার সাংস্কৃতিক দায়িত্ববোধের চেয়ে প্রশাসনিক সুবিধাবাদীতাকেই প্রাধান্য দিচ্ছে।
অমর একুশে বইমেলা কেবল একটি তারিখ নয়, এটি ইতিহাস, এটি প্রতীক। ফেব্রুয়ারি ছাড়া একুশে বইমেলা কল্পনা করা যায় না। ২০২৬ সালের বইমেলার সময় এগিয়ে আনা একটি অগ্রহণযোগ্য ও সাংস্কৃতিকভাবে ক্ষতিকর সিদ্ধান্ত। এখনো সময় আছে—বাংলা একাডেমি চাইলে সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করতে পারে। বইমেলার মূল শক্তি পাঠক ও লেখক; তাঁদের ইচ্ছা ও অংশগ্রহণকেই সর্বাগ্রে গুরুত্ব দেওয়া উচিত।
