অন্যান্য ফেসবুক থেকে পাওয়া

আমরা কি ধীরে ধীরে এমন এক শূন্যতায় ঢুকে যাচ্ছি?

লিখেছেন সাম্য রাইয়ানঃ

আমরা কি ধীরে ধীরে এমন এক শূন্যতায় ঢুকে যাচ্ছি, যেখানে সত্য বলার সাহসী কণ্ঠগুলো নিভে যাচ্ছে? লুডভিগ ভিটগেনস্টাইন বলেছিলেন, “The limits of my language mean the limits of my world.” মাহফুজা খানম ও যতীন সরকার আমাদের ভাষার সীমা বিস্তৃত করেছিলেন, আমাদের জগতকে বড় করেছিলেন। এখন তাঁদের অনুপস্থিতি মানে শুধু দুটি মৃত্যু নয়—দুটি ভাষিক মহাবিশ্বের পতন।

গতকাল প্রফেসর মাহফুজা খানম মারা গেলেন। আজ যতীন সরকার। এই দুই দিনের শোকবার্তা আমাদের জাতীয় দিনলিপির ওপর একটার পর একটা কালো দাগ টেনে দিল। যারা জীবনের দীর্ঘ সময় ধরে চিন্তা, শিক্ষা, ভাষা, সাহিত্য ও সমাজের জন্য নিজেদের উজাড় করে দিয়েছেন, তারা একে একে চলে যাচ্ছেন—আমরা দাঁড়িয়ে আছি এমন এক প্রান্তে, যেখানে বিদায়ের ধারাবাহিকতা ভয়াবহভাবে স্পষ্ট হয়ে উঠছে।

সাম্য রাইয়ান

প্রফেসর মাহফুজা খানম শুধু একজন শিক্ষাবিদই নন, তিনি ছিলেন ভাষা ও নারী-শিক্ষা আন্দোলনের দৃঢ় কণ্ঠ। তাঁর ভাষা ছিল স্পষ্ট, তাঁর অবস্থান ছিল নির্ভীক। আমার মনে পড়ে, এক বক্তৃতায় তিনি বলেছিলেন—“মেয়েদের শিক্ষিত করা মানে শুধু তাদের জীবন বদলানো নয়, সমাজের নৈতিক মানচিত্রও নতুন করে আঁকা।” মৌলবাদপ্রবণ সময়ে এই বিশ্বাসের মানুষ হারানো মানে ভবিষ্যতের ওপর আস্থার একটি স্তম্ভ ভেঙে যাওয়া।

যতীন সরকার ছিলেন অন্য ধরনের বাতিঘর। তঞ্চক রাজনৈতিক ইতিহাসকে যেভাবে তিনি ভাষা ও সাহিত্যের সঙ্গে মিশিয়ে পড়তে পারতেন, তা বিরল। তাঁর টেক্সট পাঠকের মননে দায় সৃষ্টি করতো—তুমি ইতিহাস ভুলে যেতে পারো না, কারণ ইতিহাস তোমাকেই পড়ছে। তিনি ছিলেন মাঠে-ঘাটে-গ্রামে ঘুরে বেড়ানো এক শিক্ষক, যিনি বইয়ের ভেতর আটকে থাকেননি। আজ মনে পড়ছে তপন স্যারের কথা, অধ্যাপক তপন কুমার রুদ্র—যিনি তাঁর বইয়ের প্রকাশনা অনুষ্ঠানে যতীন সরকারকে কুড়িগ্রামে অতিথি করে আমাদের সুযোগ করে দিয়েছিলেন তাঁর সান্নিধ্য প্রাপ্তির৷ আমার নিজের অভিজ্ঞতায় যতীন সরকারের টেক্সট পড়া মানে চোখের সামনে একদিকে ঐতিহাসিক বিস্তৃতি, অন্যদিকে বাঙলার মাটির গন্ধ একসঙ্গে পাওয়া। তার চিন্তার সাথে কিছুক্ষেত্রে দ্বিমত ছিলো, সেগুলো বিভিন্ন সময়ে বলেছি৷ আজ এই দুঃখভারাক্রান্ত দিনে সেসব আর উল্লেখ করতে চাই না৷

আমাদের জাতীয় বেদনার প্রকৃতি এমন যে, এটি সঙ্গে সঙ্গে উপলব্ধি হয় না। সময়ের সাথে সাথে বোঝা যায়—যাদের হারিয়েছি, তাদের শূন্যতা পূরণ হয় না কখনোই। আজ হয়তো এই ক্ষতকে ভাষায় বাঁধা কঠিন, কিন্তু ভবিষ্যতে যখন আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম জানতে চাইবে—তখন হয়তো আমরা শুধু দীর্ঘশ্বাস ফেলব, আর বলব—তোমরা তাদের দেখোনি, শুনোনি, তাই বোঝোনি কী হারিয়েছ।

মুল লেখার লিংক – https://www.facebook.com/photo?fbid=24370069245942675&set=a.603590583017208&comment_id=1825882274659119&notif_id=1755087786920616&notif_t=feedback_reaction_generic&ref=notif

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।